বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী সত্য বলেন কদাচিৎ। আর যদিও বা বলেন, সেটা প্রায়শই মুনাফেকির পর্যায়ে পড়ে যায়। সম্প্রতি তার সে ধরনেরই একটা বক্তব্য নজরে পড়লো। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যের ডঙ্কা বাজাতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, অসুখটি দেখিয়ে দিয়েছে যে অর্থসম্পদের কোন মূল্য নেই। বাংলাদেশের মানুষ সচরাচর চিকিৎসা নিতে যে সকল দেশে যেয়ে থাকে সেসব দেশে প্যান্ডেমিকের কারণে বিদেশী নাগরিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষাপটেই স্বঘোষিত মহাজ্ঞানী নারী স্বৈরাচারী শাসক উপরোক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে শেখ হাসিনা সত্য বলেছেন। কারণ, প্রচুর টাকা থাকলেও বাংলাদেশের ধনবানরা চিকিৎসা নিতে সিঙ্গাপুর, ব্যংকক অথবা লন্ডনে ছুটতে পারছেন না। তাদেরকে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। যদিও হাসপাতালে ভর্তি না করায় অনেক করোনায় আক্রান্ত অসহায় মানুষকেই অ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কোন যানবাহনে ঘুরতে ঘুরতেই বিনা চিকিৎসায় প্রাণ দিতে হয়েছে। অবশ্য ধারনা করছি বাংলাদেশের কোন ধনবান অথবা ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে এমন করুণভাবে মারা যেতে হয় নাই। যাই হোক, শেখ হাসিনার কাছে আমার প্রশ্ন ভিন্ন।
ক্ষণস্থায়ী পার্থিব দুনিয়ায় কি কেবল অর্থসম্পদ মূল্যহীন? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও কি মূল্যহীন নয়? বাংলাদেশের জনগণের ওপর দীর্ঘ এক যুগ ধরে অবর্ণনীয় নিপীড়ন চালানোর সময় ক্ষমতার দর্পে অন্ধ হাসিনার কি কখনও ইহকালের জীবনের অসারতার কথা মনে হয়? করোনা হানা দেয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনার তাবৎ ভৃত্যের দল উদ্ধতভাবে বলে চলেছেন, ইতিহাসের নির্মমতম শাসকদের অন্যতম এই মহিলাটি ক্ষমতাসীন থাকলে নাকি ভাইরাস বাংলাদেশের জনগণের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাদের এ ধরনের বক্তব্য যে সরাসরি শির্কের পর্যায়ে পড়ে সেটা পর্যন্ত ক্ষমতার দম্ভে জুলুমবাজ আওয়ামী গোষ্ঠী ভুলে গেছে। ১৪ দলের প্রধান সমন্বয়কারী, সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তো ঠিক এমনই একজন উদ্ধত ও অতি দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তি এবং শেখ হসিনার নির্লজ্জ স্তাবক ছিলেন। হাসিনা করোনার চেয়েও শক্তিশালী জাতীয় শেরেকী কথাবার্তা তার কণ্ঠে প্রায়ই শোনা যেত। অথচ লোকটি করোনাতে আক্রান্ত হয়েই মারা গেছেন। শেখ হাসিনা তাকে রক্ষা করতে পারেন নাই। নাসিমের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক শতাংশ ব্যবহারকারীকেও কোনরকম শোক প্রকাশ করতে দেখা যায় নাই। নিরানব্বই শতাংশ মানুষ বরং মৃত লোকটি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এ জাতীয় মন্তব্য করার অপরাধে ফ্যাসিবাদী বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ডিজিটাল আইনের মামলায় অনেককে জেলজুলুমের শিকারও হতে হয়েছে।
বর্তমান অনৈতিক সরকারের আর এক অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও করোনাতে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যুর পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাসিমের মতই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। আবেগতাড়িত হয়েই হোক কিংবা প্রমাদবশতই হোক, মাহবুবে আলমের মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে অসঙ্গত ও একেবারে অন্যায্য প্রশংসাসূচক মন্তব্য সহকারে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক টুইট করে রীতিমতো নাকাল হয়েছেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমালোচনার তোড়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সেই টুইট শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করতে হয়েছিলো। করোনা যে বেছে বেছে কেবল সরকারের ক্ষমতাধরদের ধরছে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। অনেক বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণ করোনাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তারা কেউ বলেন নাই যে আল্লাহ্ ব্যতীত এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের আর কেউ শক্তি রাখেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তায়ালাই জানেন আরও কতজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন কিংবা মারা যাবেন। অসুখটি আরও কতদিন পৃথিবীর বুকে তাণ্ডব চালাবে তাও একমাত্র তিনিই জানেন। শেখ হাসিনার মুনাফেকি বচন প্রসঙ্গেই আমি মোহাম্মদ নাসিম এবং মাহবুবে আলমের করোনায় মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করলাম। শেখ হাসিনা অন্যের সম্পদের অসারতার বচন দিলেও তার পরিবার যে বিগত এক যুগে রাষ্ট্রের সম্পদ ডাকাতি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন সে সম্পর্কে অবশ্য কিছু বলেন নাই।
শেখ হাসিনা সম্প্রতি আরও বলেছেন যে তিনি নাকি ছোট জেল থেকে বড় জেলে আছেন। বাংলাদেশের এক দালাল মিডিয়ায় প্রকাশিত পুরো সংবাদটি পড়বার রুচি না হওয়ায় ঠিক কি প্রসঙ্গে হাসিনা সেই মুনাফেকি বচনটি দিয়েছেন তা সঠিকভাবে বলতে পারছি না। তবে ধারনা করছি, নিরাপত্তার বিষয়ে অতি সাবধানী ফ্যাসিস্ট শাসক হয়তো বা তার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীজনিত জনবিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গেই এমন বচন দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার মত এমন স্তরের পর স্তর নিরাপত্তা নিয়ে আর কোন রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান কোনদিন চলাফেরা করেন নাই। তার বিশাল নিরাপত্তা বহরের যাতায়াতসৃষ্ট ভয়াবহ যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটক থেকে পেরেশানিতে পড়েন নাই এমন ব্যক্তি ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেই আমার ধারনা। তবু শেখ হাসিনাকে অহরহ বলতে শুনবেন, ‘তিনি মৃত্যুকে ভয় করেন না’, ‘তার হারানোর কিছু নাই’, ‘তিনি দেশের জন্য বুকের রক্ত দিতে সর্বদা প্রস্তুত’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে ভাই, যে মৃত্যুকে ভয় করে না, যার হারানোর কিছু নাই, যে কিনা বুকের রক্ত দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে, তার আবার আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চাইতেও বেশি নিরাপত্তা লাগে কি কারণে? কারণ একটাই। তিনি মৃত্যুকে ভয় পান এবং তার হারানোরও অনেক কিছু আছে।
আল্লাহ্তায়ালা শেখ হাসিনার অন্তরে এমন সিলই হয়তো মেরে দিয়েছেন যে, তিনি মুখ খুললে সেখান থেকে কেবল মিথ্যা এবং মুনাফেকি বচনই বের হয়। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, মাত্র কিছুদিন আগে প্রণব মুখার্জী পরপারে গেলে এই হাসিনাই চোখের পানিতে [দুঃখিত ভুল হয়ে গেল, ওনাদের জন্য তো আবার শব্দটা ‘জল’ হবে। বর্তমান বাংলাদেশে ‘পানি’ তো এক অচ্ছুৎ রাজাকারি শব্দ।] বুক ভাসিয়ে আর্তনাদ করে বলেছেন তার নাকি অতি আপনজন চলে গেছে। নতুন জানলাম যে, যার হারানোর কিছু থাকে না তারও নাকি আপনজন থাকে। সেই আপনজন আবার কেবল বিদেশীই নয়, তিনি ভিন্ন ধর্মেরও। ভারতে প্রণবের মত আরও কত আপনজন হাসিনার আছে তা তিনিই ভাল জানেন।
আর একটি হাসিনাবচনের উল্লেখ করেই আজকের সম্পাদকীয়তে ইতি টানব। ‘বাংলাদেশের জনগণ ভোট না দিলে একটি দিনও ক্ষমতায় থাকতে চাই না’। জি, এটিও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন একনায়কের অতি প্রিয় বচনের একটি। বাক্যটি তিনি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে, পাঁচ বছর পরপর যখনই নির্বাচনের নামে দেশে তামাশার আয়োজন হয়, তখন অসহায় জনগণকে দিনে কয়েকবার এই মুনাফেকি বচনটি শুনতে হয়। ফলাফল আগে থেকেই দিল্লী, ওয়াশিংটন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিলিতভাবে ঠিক করে রাখলেও, সেই ২০০৮ সালের সমঝোতার নির্বাচনেই বাংলাদেশের ভোটাররা শেষ বারের মত অন্তত ভোটকেন্দ্রে যেতে পেরেছিল। শেখ হাসিনার সরকার তারপর থেকে তো জনগণকে ভোট দেয়ার কষ্ট থেকেও মুক্তি দিয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে জনগণ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগটা পাচ্ছে কোথায়? পৃথিবীর অনেক দেশেই একনায়কতন্ত্র চলছে। রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ইজিপ্ট, সিরিয়া, উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ, ইত্যাদি। কিন্তু কোন একনায়কই শেখ হাসিনার মত জনগণকে নিয়ে এমন নিষ্ঠুর তামাশা করছেন না। রাশিয়া এবং ইজিপ্টে এক প্রকার ভোটাভুটির আনুষ্ঠানিকতা আছে বটে। কিন্তু পুতিন বা সিসিকে নির্লজ্জের মত জনসমর্থনের বড়াই করতে শুনবেন না। তারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে জনগণের ইচ্ছায় নয়, রাষ্ট্রশক্তির জোরেই ক্ষমতায় টিকে আছেন। এটাও এক ধরনের সততা বৈকি। এইটুকু সততা দেখাতে পারলেও শেখ হাসিনাকে বাহবা দিতাম।