জমি সংক্রান্ত মামলা: ৪০ বছর আদালতে ঘুরছেন বারেক দম্পতি

logo

 

শরিফ রুবেল

১৫ জুলাই ২০২৩, শনিবার

ওদের অনেক ক্ষমতা। আমগো ক্ষমতা নাই। আমগো ঘরের সঙ্গে হেরা জোর করে বেড়া দিয়া রাখছে। ঠিকমতো ঘর থেকে বের হতে পারি না। রাস্তায় যেতে পারি না। বাপ- দাদা যেই জমি ভোগ করিছে। তা এখন বেদখল হয়ে গেছে। নিজের জমি থাকতেও অহন অন্যের জমি দিয়ে হাঁটাচলা করতে হয়। জমির উপর মামলা আছে। ৪০ বছর ধরে মামলা চলছে।

৮৪ সালে মামলা করছি। ৯৭ সালে আমরা রায় পাইছি। তবুও জমিতে যাইতে পারছি না। হেরা দখল ছাড়ছে না। জোর করে ভোগ করছে। আমরা রায় পাই। হেরা আবার আপিল করে। এভাবে সময় পার করছে।

এতো ভোগান্তি হবে জানলে মামলা করতাম না। দুই কোর্টে রায় পেয়েও কাজ হচ্ছে না। ওরা আপিল করে ঝুলায় রাখছে। আদালতে ঘুরে আর পারছি না। এই বয়সেও প্রতিমাসে হাইকোর্টে আইতে হয়। কোর্টে আয়া বসে থাকি উকিলের দেখা পাই না। দেখা হলে উকিল সাব বলে মামলা তালিকায় উঠে নাই। অপেক্ষা করেন। এ কথা শুনে আবার কুমিল্লা ফিরে যাই। এমন আসা-যাওয়ায় ১০ বছর চলে গেছে। অনেক টেকা ঢালছি। ছেলে মেয়ে রাগ করে। তবুও মন মানে না।

বাপ দাদার জমি ছাড়তে চায় কে? তাই আদালতে আসি। যদি জমি ফিরে পাই এই আশায়। অহন মনে হয় জীবিত থাকতে শেষ রায় দেখতে পারমু না। আরও কত বছর লাগে আল্লাহ্‌ মা’বুদ জানে। হাইকোর্টে দেখা হলে এমনটিই বলছিলেন হাইকোর্টে বাটোয়ারার মামলা নিয়ে ঘুরতে থাকা আব্দুল বারেক। বারেকের বাড়ি কুমিল্লা সদরের কোটবাড়ী এলাকায়। বয়স ৮২ বছর।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও বসতভিটা উদ্ধারে আদালতে ঘুরছেন। বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিমাসে হাইকোর্টে আসছেন। তবুও সমাধান মিলছে না। মামলার তারিখ আসে। শুনানি হয়। কিন্তু কোনো সুরাহা হয় না। বিচারিক আদালতে দুই দফা রায় পেয়েও দখল পাচ্ছেন না। সাব জজ আদালত থেকে মামলা গিয়ে ঠেকেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। হাইকোর্টে আদেশের পর কোনো পক্ষ খোঁজ না রাখায় অনিষ্পন্ন অবস্থায় মামলার ১০ বছর চলে গেছে। ১০ বছর পর আপিল করা হয়।

এখন মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। মাসে মাসে কার্যতালিকায় আসে তবে শুনানি হয় না। কখনো বারেক উপস্থিত থাকেন না আবার কখনো আইনজীবীও খোঁজ রাখেন না। জীবন সায়াহ্নে এসেও স্বামী-স্ত্রী প্রতি মাসে আদালতে ঘুরছেন। আক্ষেপ নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কবে নিষ্পত্তি হবে? এই প্রশ্নের জবাব পাচ্ছেন না আব্দুল বারেক। জীবনের অর্ধেক সময় ধরে মামলা চালাচ্ছেন। মামলার পেছনে টাকা ঢেলে প্রায় নিঃস্ব হয়েছেন। এক আদালতে রায় পান আবার যেতে হয়  অন্য আদালতে। এভাবে ৪০ বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরেও কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

মামলার আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ আলী আজম বলেন, দেওয়ানী মামলা বিচারে একটু ধীরগতি আছে। তবে আব্দুল বারেকের মামলা দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আছে। এই মাসেই শুনানি হবে। তবে যেহেতু পেছনের সব আদালতে সাব-জজের আদেশ বহাল রেখেছে। আপিল আদালতেও আগের আদেশ বহাল থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এক দুই বছরের মধ্যেই এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। আসলে বণ্টনের মামলাগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া একটু দীর্ঘ হয়। এখানে বাদি-বিবাদী মিলে ৫০ থেকে ৬০ জন জড়িত থাকে। এতো মানুষকে নোটিশ করতেই ৫ বছর চলে যায়।

মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে জমির বণ্টন নিয়ে প্রতিবেশী রহমান বিবির সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। দীর্ঘদিন বিরোধের পরে সঠিক বণ্টন চেয়ে কুলিল্লা প্রথম সাব-জজ আদালতে ১৯৮৪ সালে মামলা করেন আব্দুল বারেক। মামলা নং ৪৬/৮৪। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষ ১৯৯৭ সালে বাদী পক্ষকে ২ একর ৮৬ শতাংশ ও বিবাদী পক্ষকে ৩৯ শতাংশ জমি দিয়ে ডিক্রি জারি করেন কুমিল্লা প্রথম সাব-জজ আদালত। রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে বিবাদীপক্ষ ১৯৯৮ সালে কুমিল্লা জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। আপিল নং ৩০/৯৮।

পরের বছর সাব-জজের আদেশ বহাল রেখে ১৯৯৯ সালে আপিল খারিজ করে দেন জেলা জজ আদালত। পরে প্রায় ১০ বছর পর ২০০৯ সালে জেলা জজের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে  বিবাদীদের পক্ষে আপিল করেন সুলতান মিয়া। হাইকোর্টে এসে জট লেগে যায়। প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস পরপর কার্যতালিকায় এলেও শুনানি হয়নি।

তবে ২০১৫ সালের পরে নিয়মিত শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালে আপিল খারিজ করে সাব-জজ আদালতের আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম শহিদুল হক এ আদেশ দেন। এর এক বছর পরে ২০১৯ সালে আপিল বিভাগে যান বিবাদীপক্ষ। ১৯ সালে আপিল করলেও করোনার কারণে এখন পর্যন্ত শুনানি হয়নি। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগের নিয়মিত কার্যতালিকায় আছে। শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।