মোরশেদুল আলম
সম্প্রতি একটি খবর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে—জনপ্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের দুটি পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের জন্য বাসভবন নির্মাণ করে দেবে সরকার। এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই; তবে চিন্তার বিষয় এ প্রকল্পের কলেবর নিয়ে এবং প্রকল্পের জন্য যে খরচ হবে, তার উৎস নিয়ে। নথি অনুযায়ী, এ বাসভবন নির্মাণে খরচ হবে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। এর চেয়েও বড় বিষয় হলো প্রতিটি ভবনে নাকি সুইমিংপুল থাকবে, যার জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই বিশাল অঙ্কের টাকা আসলে কোথা থেকে আসবে? অবশ্যই জনগণের করের টাকা থেকে, যা সরলীকরণ করলে দাঁড়ায়—পাবলিক মানি।
এখন প্রশ্ন হলো, যে শহরে মানুষ বিল পরিশোধ করেও ঠিকমতো ওয়াসার পানি পান না, এই শহরের মাঝখানে সেই জনগণের টাকা দিয়েই জনগণের কথিত সেবকদের জন্য এমন বিলাসী বাসভবন নির্মাণ কতটা যুক্তিসংগত? তা–ও আবার এমন এক সময়ে, যখন আমরা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং সাধারণ মানুষের দৈনিক খাবারের জোগান দিতেই নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। এই যে জনগণের টাকা বিভিন্নভাবে অপচয় করা হয়, এ জন্য কি কোনো জবাবদিহির প্রয়োজন আছে? যদি থাকে, সেই জবাব দেবে কে? অপচয়ের এমন আরও ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় জনস্বার্থে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়।
যেমন ধরুন ডেমু ট্রেনের কথা। সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে চীন থেকে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার (রেল বিভাগ) ২০টি ডেমু (ডিজেল-ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কেনার প্রকল্প হাতে নেয়। রেল কর্তৃপক্ষ মূলত স্বল্প দূরত্বের ভ্রমণের সুবিধার্থে এ প্রকল্প গ্রহণ করে। এ মাধ্যমে জনগণের যাতায়াত আরও সহজ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মাত্র ৯ বছরের মাথায় বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। যাতায়াত–সুবিধা তো দূরের কথা, আপনি এখন আর কোনো ডেমু ট্রেন রেললাইনে চলতেই দেখবেন না!
২০১৩ সালে রেলওয়ে যে ২০ সেট ডেমু কিনেছিল, সেগুলো রেললাইনে চালুর মাত্র তিন বছরের মাথায় অকেজো হতে শুরু করে। বর্তমানে সব কটি ডেমু ট্রেনই অচল হয়ে পড়ে আছে। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এই ট্রেনগুলোর ইঞ্জিনের বয়সসীমা বলা হয়েছিল ২০ বছর। মাত্র ৯ বছর পর ডেমুগুলো আর রেললাইনে দেখা যাচ্ছে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সে সময় প্রায় ৪৮ লাখ টাকা খরচ করে ডেমুর কার্যকারিতা ও কারিগরি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে আটজন সরকারি কর্মকর্তাকে স্টাডি ট্যুরে (প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে) পাঠানো হয়েছিল। সে বিদেশ সফর সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তবে অর্জিত জ্ঞান আর প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
তার মানে কী দাঁড়াল? প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেটি আর জনগণের কোনো উপকারে আসছে না। সোজা ভাষায়, রেল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে করদাতাদের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা গেছে। এই যে জনগণের টাকা নষ্ট হলো, এর দায়ভার কে নেবে? জবাব দেবে কে?
একইভাবে প্রতিদিনই আমরা বিভিন্ন দৈনিকে এমন খবর পড়ি, যা বিভিন্ন সরকারি অফিস ও সংস্থার দ্বারা বিভিন্ন সময়ে গৃহীত ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জনসাধারণের অর্থ অপব্যবহার ও অপচয়ের দুঃখজনক চিত্র তুলে ধরে। যদিও রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পর্যায়ের কেউই এ বিষয়ে খুব বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে না কিংবা উচ্চবাচ্য করে না। শেষ পর্যন্ত শুধু জনসাধারণ ও করদাতাদের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে।
জনসাধারণের অর্থের লাগামহীন অপচয়ের ঘটনা প্রায়ই স্পটলাইটে এলেও আমাদের দেশে এটি একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো, জনগণের অর্থের অপচয় করার জন্য কাউকেই প্রকৃতপক্ষে জবাবদিহি করতে হয় না এবং কাউকে আইনের আওতায় এনে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগও নেই। জনসাধারণের অর্থের এ ধরনের ভয়ংকর রকমের অপচয়ের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার যে কোনো প্রতিফলন নেই, তা–ই প্রমাণ করে।
এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেহেতু আমলাদের জন্য সঠিক জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই, তাই তাঁরা সঠিক পর্যালোচনা ছাড়াই যেমন খুশি তেমন প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং প্রকল্পের জন্য খরচ করেন। যার ফলে বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা করার সময় দূরদর্শিতা ও সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের অভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এমন সিদ্ধান্ত, যা অদূর ভবিষ্যতে জনগণের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না। ডেমু ট্রেন প্রকল্প এমন ভুলে ভরা ও দূরদর্শিতাবিহীন চিন্তার ফসল। দিন শেষে এমন প্রকল্প শুধু জনসাধারণের অর্থ অপচয় ও কিছু মানুষের পকেট ভারী করতেই কাজে আসে।
আবার আমলাদের এমন মানসিকতা তৈরি হওয়ার পেছনে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮–এর ভালো অবদান আছে। এই আইনের বিভিন্ন ধারা, বিশেষ করে, ৪১ ধারার উপধারা (১) আমলাদের লাগামহীন সাহস জোগাতে ভূমিকা রাখে। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হইবার পূর্বে তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হইলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।’ এমন স্বাধীনতার ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে জবাবদিহির অভ্যাস ও স্বচ্ছতার তাগিদ একদম কমে গেছে। যে কারণে কোনো প্রকল্পে কে কীভাবে জনগণের টাকা নষ্ট করছেন, সেটা আর বিবেচ্য বিষয় নয়। এমন বৈষম্যমূলক আইনের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো অন্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলোও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
এমন অপচয় একধরনের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নিপীড়ন। যখন সবাই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ও কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি, তখন আমাদের (করদাতাদের) অর্থ নষ্ট হচ্ছে, এমন খবর মনকে আরও অশান্ত করে তোলে, মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করে। বিশেষ করে যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বারবার সবাইকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়াতে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সময় আরও সতর্ক থাকতে বলছেন, তখন আমলাদের এমন খামখেয়ালি আচরণ সবাইকে ব্যথিত করে। আমাদের বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী যখন সবাইকে দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করতে বলছেন, তখন সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রকল্পের নামে জনসাধারণের অর্থ নষ্ট করছেন। এটা দুঃখজনক, বিশেষত যখন আমলারা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।
এমন পরিস্থিতি আমাকে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে কবি তৎকালীন সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সে সময়ের পরিস্থিতিকে বাজপাখির সঙ্গে তুলনা করেন। কবি বলেন, সমাজ এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ, পাখির (ফ্যালকন) ওপর এর মালিক (ফ্যালকোনার) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা বোধ হয় এই পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
দিন যত যাচ্ছে, আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুল্ক, কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে তত বেশি মরিয়া হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বাজেটের আকার যত বড়, মানুষের পকেটের ওপর এনবিআরের পক্ষ থেকে চাপ তত বেশি বাড়ে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কিংবা মানুষের দুর্বিষহ অবস্থার সময় এনবিআরের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না, সেটা করার কথাও নয়। তাতে কোনো সমস্যা নেই; তবে প্রশ্ন হলো, যদি সরকার চায় রাজস্ব বোর্ড এতটা মরিয়া হয়ে কর আদায় অব্যাহত রাখবে, তাহলে সরকার ও আমলাদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে জনগণের এই কষ্টের টাকার যেন কোনো রকম অপচয় না হয়।
এর জন্য সবার আগে কর্তৃপক্ষের মধ্যে যাদের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের কারণে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় অকারণে টাকা অপচয় হয়, তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। জনগণের টাকা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, সেটা জানার অধিকার নিশ্চয় এ দেশের মানুষের আছে। দায়মুক্তির এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা যদি জনগণের অর্থ ব্যবহার করার সময় আরও একটু সতর্ক হন, তবে তা দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে।
মোরশেদুল আলম যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত