আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

  • রেজাউল করিম
  •  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:২১
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। – ছবি : সংগৃহীত

‘Think Positive, Be Positive’. এমনটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। অথচ সারা জীবন নিজের চেহারার ধুলা না মুছে কেবল আয়না মুছে যাচ্ছি। একটু ইতিবাচক মন্তব্যের অভাবে একজন পরিশ্রমী মানুষের সফলতা আটকে যেতে পারে। আবার একটু ইতিবাচক মন্তব্যে কেউ কেউ সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যায়। এমন ইতিবাচক ভাবনার বড় অভাব। বলতে চাচ্ছি, হিরো আলমের প্রসঙ্গে। যাকে নিয়ে সমাজ প্রতিনিয়ত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে যাচ্ছে। আধুনিক ট্রোলের শিকার হচ্ছে গ্রাম থেকে উঠে আসা হিরো আলম। বিষয়টি তিনিও জানেন। না চেহারা, না শারীরিক গঠন, না শিক্ষা, না বাচনভঙ্গি, কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না বিদ্রুপের আক্রমণ থেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রোলের কারণেই তিনি এখন অন্যতম পরিচিত মুখ।

আমি উল্টো ভাবছি। এত ট্রোলের পরেও তিনি লড়ে যাচ্ছেন। বলা যায়, লড়ে যাওয়া হিরো। এটাই বা কম কিসের। নানা সময়ে নানা কারণে হিরো আলম হয়েছেন আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। খুব কম মানুষই বিষয়টি ইতিবাচক দিক থেকে ভাবছেন। সর্বশেষ বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। কোনো কোনো গণমাধ্যম অনেকটা নিশ্চিত করেছিল এবার এমপি হচ্ছেন হিরো আলম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এলো, বগুড়া-৪ আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন তিনি। আলমের অভিযোগ, ‘ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন আমার বিজয় ছিনতাই করে প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।’ এরপর হিরো আলমের পক্ষ থেকে এলো আরো জোরালো বক্তব্য। বললেন, ‘আমাকে স্যার ডাকতে হবে বলে শিক্ষিত মানুষ আমাকে হারিয়ে দিয়েছে।’ সত্য মিথ্যে যাচাই করতে যাবো না, তবে বক্তব্যটি বিদারক। যেহেতু নির্বাচনী আইনে শিক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই। আগেও অনেকে এমপি হয়েছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সামান্যই। সে ক্ষেত্রে হিরো আলমের যোগ্যতা নিয়ে সমালোচনার সুযোগ নেই। এ ছাড়া গায়ক-গায়িকা-নায়িকা, নাট্যকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমনকি খেলোয়াড় বিগত দিনে এমপি হয়েছেন। তখন কিন্তু কারো যোগ্যতা নিয়ে কথা ওঠেনি। তবে আলমের যোগ্যতা নিয়ে এত আলোচনা কেন? বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা অতি সাধারণ থেকে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসেছেন। আমেরিকার এক রাষ্ট্রপতি প্রথম জীবনে বাদাম বিক্রি করতেন, তা নিয়ে গর্বের শেষ নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চা বিক্রি করতেন, তাও তাদের কাছে গর্বের। নায়ক রাজ্জাকের ঢাকা শহরে থাকার জায়গা ছিল না, সেটাও চলচ্চিত্র শিল্পীদের প্রেরণা। যত সমস্যা সিডি বা ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলমের ক্ষেত্রে। তিনি কেন মিউজিক ভিডিও বানাবেন, নিজেকে কেন হিরো দাবি করবেন? তিনি কেন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন?

মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা হন বিশ্বরাজা। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তাদের অনেকের শুরু ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতার। কৃষক পরিবারের সন্তান জর্জ ওয়াশিংটন ভূমি জরিপের কাজ করতেন। জন অ্যাডাম ছিলেন স্কুলমাস্টার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত টমাস জেফারসন ভার্জিনিয়ার উইলিয়ামসবুর্গে পেশাদার উকিল হিসেবে ভ‚মিবিরোধ সংশ্লিষ্ট মামলা নিয়ে কাজ করেন। অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ১৩ বছর বয়সে যুদ্ধে যোগ দেন এবং তথ্য আদান-প্রদানকারী হিসেবে কাজ করেন। আব্রাহাম লিংকন এক জেনারেল স্টোরে কেরানির কাজ করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এখান থেকেই শহরের প্রায় সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। অ্যান্ড্রু জনসন ছিলেন শিক্ষানবিস দর্জি। আততায়ীর হাতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের হত্যার সময় অ্যান্ড্রু জনসন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরে তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। রাফ আন্ড্রিস্ট-এর বই ‘এরি ক্যানাল’র তথ্যানুসারে জেমস গারফিল্ড চালাতেন খচ্চরে টানা নৌকা। বেনজামিন হ্যারিসনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, উকিল হিসেবে নিজের জীবন শুরু করার আগে তিনি আদালতের পক্ষ থেকে দিনে আড়াই ডলার পারিশ্রমিকে আদালত-চত্বরে পেশাদার হকারের কাজ করতেন। চিৎকার করে লোকজন ডাকাই ছিল তার কাজ।
৩৬তম প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন প্রথমে মুচির কাজ করতেন। পরে চাচার খামারে রাখালের কাজ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম এই প্রেসিডেন্ট কসাইয়ের দোকানে মুরগির চামড়া ছাড়ানোর কাজও করেছেন। ইয়েলো স্টোন পার্ক ফাউন্ডেশনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড প্রথম জীবনে ইয়েলো স্টোন পার্কের রক্ষী হিসেবে কাজ করতেন। দ্য উইকের তথ্যমতে, ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ছিলেন সার্কাসের কর্মী। ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আরকানসায় এক মুদি দোকানে কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাস্কিন-রবিন্সের হনুলুলু শাখায় একজন আইসক্রিম বিক্রেতা ছিলেন।

দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশ ব্রাজিল। ব্রাজিলের কারখানা শ্রমিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি হন লুলা দা সিলভা। জুতো পালিশের টাকা জমিয়ে কিনলেন ঝুড়ি আর চিনাবাদাম। আয় কিছুটা বেড়ে গেল। এরপর পেলেন কারখানায় লোহা কাটার কাজ। একদিন আঙুলটাই কেটে গেল লুলার। তার মা-বাবা ছিলেন নিরক্ষর। ১০ বছর বয়সে পড়তে শিখেছিলেন। ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়েছিলেন লুলা। সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসানে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। একটি শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৮০ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন লুলা। দলটি ২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসে এবং ১২ বছর ক্ষমতাসীন থাকে। তিনি তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। জন ডি. ফ্রেঞ্চ ‘ফ্রম মেটাল ওয়ার্কার টু প্রেসিডেন্ট অব ব্রাজিল’ শিরোনামে লুলার জীবনী প্রকাশ করেন। বইটিতে তাকে একজন বিশ্বনন্দিত আকর্ষণীয় ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যাকে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

বিশ্ব রাজাদের এমন অতীত হলে আলমকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? আশরাফুল আলম বগুড়ার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আশরাফুল আলম সাঈদ সিডি ব্যবসা, ডিশ ব্যবসার এক পর্যায়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে হয়ে উঠেছেন হিরো আলম। নিজের বানানো মিউজিক ভিডিওতে নিজেই হিরো। নিজেকে হিরো ভাবাটাই কি হিরো আলমের দোষ? টিভিতে প্রায়ই দেখা যায় উপস্থাপক বলছেন, আপনি তো দেখতে হিরোর মতো নন তাহলে হিরো ভাবেন কেন?

সম্প্রতি এমপি নির্বাচনে অনেক সংবাদকর্মীকে প্রশ্ন করতে দেখা গেছে, আপনি কেন নির্বাচনে এলেন? নাম কেন হিরো আলম? ইসি সচিব বললেন ‘হিরো আলমও…। এটা তো আলমের গণতান্ত্রিক অধিকার। মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন। তাহলে তার জনপ্রিয়তাইবা কম কিসের? আলম দেখতে সুন্দর নন। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। এটা কি দোষের নাকি দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ? এক সময় কলকাতার দর্শক বাংলাদেশের নাটক দেখতেন। এখন যে বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের টেলিভিশনের নাটক-সিনেমা দেখেন না, কারণ কী? টেলিভিশনের নাটক-সিনেমায় তো হিরো আলম বানান না। দেশের পুরো সংস্কৃতিই পাল্টে গেছে। হিরো আলম পাল্টায়নি। হিরো আলমকে দিয়ে একটি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্রে অভিনয় করান দেখবেন তার পেছন থেকে সমালোচনা উঠে গেছে।

‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, আমরা সমাজকে বদলে দেবো’ নামে হিরো আলম একটি বই লিখেছেন। বইটিতে স্বশিক্ষিত একজন হিরো আলম সমাজের উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন আমরা কোন পথে আছি। বলতে পারেন অভিনয় করতে যোগ্যতা লাগে। এ বিষয়ে পড়ালেখার প্রয়োজন হয়। উত্তরে আসতে পারে এ বিষয়ে ক’জন শিল্পীইবা পড়ালেখা করেছেন। যদি বলেন, ইউটিউবে ইচ্ছেমতো কনটেন্ট তৈরি করে ভাইরাল হন তিনি। উত্তর আসতে পারে, ইউটিউব নিয়ে কতটাই বা জোরালো আইন আছে দেশে। যদি অভিনয়ে যোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে তাহলে উত্তরে আসতে পারে ব্রিটিশ কমেডিয়ান মি. বিনের কথা। তার আসল নাম রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন। তার বাবা ছিলেন কৃষক আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিনি কিন্তু স্পষ্ট করে কথা বলতে পারতেন না। যাকে বলে তোতলা। কথা না বলেও মি. বিন চরিত্রে নির্বাক অভিনয় করে রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন থেকে পরিচিতি পেলেন মি. বিন। তিনি একজন সফল মানুষ, সফল অভিনেতা। সে ক্ষেত্রে হিরো আলমকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? অন্য দিকে, রাজনীতিতে স্টাডির প্রয়োজন। লেখাপড়ার প্রয়োজন আছে। এটা ঠিক। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে কজন স্টাডি করছেন। স্বল্পশিক্ষিতরাও তো এমপি হচ্ছেন। তাহলে হিরো আলমকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? নির্বাচনে হেরে গিয়ে উপহার পাওয়া গাড়িটি জনকল্যাণে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে দিলেন। এতেও আমাদের বিবেক নীরব? তিনি লিখছেন, গাইছেন, অভিনয় করছেন। পাশাপাশি রাজনীতিও করছেন। আমরা অনেকেই যা পারছি না, হিরো আলম সেটা করার চেষ্টা করছেন। তার চেষ্টাটাইবা কম কিসের? আসলে সমস্যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

rezaulpress.bd@gmail.com