- খন্দকার হাসনাত করিম
- ১১ এপ্রিল ২০২২, ২০:৩৭
প্রযুক্তির বদৌলতে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। তবে প্রশ্ন হলো, সেটি কোন পৃথিবী? সমগ্র পৃথিবী, নাকি পাশ্চাত্য-শাসিত বা ‘ন্যাটো প্রভাবিত পৃথিবী? এই যে আজ ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে, ধ্বংস হচ্ছে নগরীর পর নগরী। এই দৃশ্য আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমের কল্যাণে শুধু ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতিটাই দেখতে পাচ্ছি। জগৎবাসী কি দেখতে পাচ্ছে ‘ন্যাটোয়’ সরাসরি মদদপুষ্ট ইউক্রেনের হামলায় রাশিয়ার কোথায় কোন রণাঙ্গনে কোন শহরে কতটা ক্ষতি হচ্ছে? তাহলে কী করে বলি ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী? পশ্চিমা মোড়লরা একযোগে যেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে জোট বেঁধে লড়াই শুরু করছে। অথচ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোস্লাভাকিয়া, মালডোভা, সার্বিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়াকে লাখ লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে। কোথায় তাহলে পশ্চিমা ইউক্রেন-প্রেমিকরা? তারা ইউক্রেনকে বাঁচানোর চেয়ে রাশিয়াকে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে খারিজ করার জিহাদে নেমেছে। পারলে তারা রাশিয়ার জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদও খারিজ করতে চায়। যে রাশিয়া ইউক্রেনকে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর থেকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে, সেই রাশিয়া কেন আজ ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে ইউক্রেনকে, সেই মূল্যায়ন কি কেউ করছে আজ? রাশিয়ার এতদিনের বন্ধু ভারতও আজ ক্যাশ ডলার আর ‘কোকা-কোলার’ লোভ সংবরণ করতে পারছে না! অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে চলেছে শুধু গণচীন। চীন আবার প্রমাণ দিয়ে চলেছে যে, সে-ই হলো আগামী পৃথিবীর দায়িত্বশীল নেতা। চীন বা ইরান পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আগ্রাসন সমর্থনযোগ্য নয়। তবে নিষেধাজ্ঞাও সমর্থনযোগ্য নয়। কথায় কথায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র প্রয়োগ করা মুক্ত পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি স্পষ্ট চপেটাঘাত।
আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি ‘মুক্ত পৃথিবীর’ উদারনীতি যে আজ পথে বসতে চলেছে কেউ কি সে দিকে চোখ রাখছেন? অবাধ বাজারব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখেই পৃথিবীতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এত বিস্তার ঘটেছে। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই আমেরিকা রাশিয়ার একটা বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম অকার্যকর করে দিয়েছে। ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়ার জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক টিভি সংবাদ চ্যানেল আরটি (রাশিয়ান টেলিভিশন)। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের সেই খবর বা সেই ছবিই জগৎ আজ দেখতে পাচ্ছে যেটা পশ্চিমারা পছন্দ করছে বা যেটা তাদের প্রচার কাজের অনুকূল। এটাই কি অবাধ বা মুক্ত উদারনীতির নমুনা? আমেরিকার বার্মা-নীতি বা ইসরাইল-নীতির সাথে রাশিয়া-নীতির তুলনা করে দেখুন, তাদের বিদেশনীতির আদর্শ কতটা একচোখা বা একদেশদর্শী। ইউক্রেনের গণহত্যা ‘গণহত্যা’ আর প্যালেস্টাইন বা রাখাইনের গণহত্যা ‘গণহত্যা’ নয়? তাহলে আমেরিকা বর্মি ঘাতক বা ইসরাইলি পিশাচদেরকে ‘যুদ্ধপরাধী’ আখ্যা দেয়নি কেন? কথায় বলে ‘গাতায় পড়লে হাতি, ব্যাঙেও মারে লাথি’। রাশিয়ার এই বিপর্যয়ের দিনে অতীতের সব ক্রোধের ঝাল মেটানোর এই পশ্চিমা শঠতা আমাদেরকে ‘লিগ অব নেশন্স’ কিংবা ভার্সাই চুক্তির ব্যর্থতার কথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আজকের এই রাশিয়ায়ই কি মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেন-ফ্রান্স-স্পেন-আমেরিকা-কানাডাকে হিটলারের মহা-উত্থান থেকে বাঁচায়নি? রাশিয়াকে ছাড়া আজকের এই বিশ্বশাসনের ‘মওকা’ কি পেত তথাকথিত পশ্চিমা বা উত্তর-আটলান্টিক বন্ধুসঙ্ঘ? সুযোগ বুঝে আজ অনেকেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে দল বেঁধেছে। কিন্তু হায়, হাতির দাম লাখ টাকা, তো সে হাতি জ্যান্তই হোক বা মৃতই হোক। রাশিয়া মানেই জগতে ভারসাম্য, আর চীন-রাশিয়া মানেই ভবিষ্যতের পৃথিবী। এই বাস্তব সত্যটা আমরা যেন একটিবারও ভুলে না যাই। ‘ইউক্রেন, ইউক্রেন’ করে আজ যারা বিশ্বজুড়ে শোরগোল তোলার চেষ্টা করছে তারা পৃথিবীর সামনে অত্যাসন্ন বিপদের ঝুঁকিগুলোকেও ‘ওয়াক-ওভার’ দিচ্ছে। জগতের অসাধু মুদ্রা (বিট-কয়েন) আজ বিশ্বজুড়ে জেঁকে বসতে শুরু করেছে। এতকাল কারবার চলত রেখে ঢেকে। এখন শুরু হয়েছে বিট-কয়েনের প্রকাশ্য কারবার। কারা এটা করছে? আলবৎ পশ্চিমারা, ইউরোপীয়রা। হন্ডুরাস, মেক্সিকো নিশ্চয়ই বিট-কয়েন কারবারি নয়। বিশ্বের আর্থিক আপৎ এই ‘জুয়াড়ি’ মুদ্রা বিট-কয়েন এই প্রথমবারের মতো নিউ ইয়র্ক স্টক একচেঞ্জে প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করল। অবৈধতা ও অনৈতিকতাকে বৈধতা দেয়ার কী চমৎকার পশ্চিমা সুনীতি! আমেরিকার স্টক মার্কেটে এতবড় কেলেঙ্কারি হতে দেখেও তারা চুপ। অথচ বিশ্বজুড়ে মোড়লিপনার দাপট দেখানোর বেলায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। তবে এভাবে বেশি দিন চলবে না। আজ থেকে ৪৫-৫০ বছর আগে এডগার স্নো লিখে গেছেন ‘দি ইস্ট ইজ রেড’। আর ডা: হেনরি কিসিঞ্জার তার ‘দি হোয়াইট হাউজ ইয়ারস’ বইতে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘পৃথিবীর শক্তি কেন্দ্র দ্রুত আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে সরে যাচ্ছে।’ প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে রণাঙ্গনের আগুনে কেক বানিয়েছিল আমেরিকা। সত্যিকারের কেক বেকিং-এর কষ্ট তাই তাকে করতে হয়নি। চীন-রাশিয়া বাস্তবতার আগুনে নতুন পৃথিবীর জন্মদিনের কেক বানাচ্ছে। কবি সুকান্তের কথায় : ‘পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।’ সেই রকম এই নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবীর শুভজন্ম সমাগত। তাদের তৈরি এই কেকই হবে সেই নতুন বিশ্ব-শিশুর জন্মদিন বরণের সুমিষ্ট স্বাদ। কাজেই এ পৃথিবীর সেসব স্বাধীনচিত্তের দেশ ও মানুষের উচিত হবে মার্কিন-ন্যাটো-ইউরোপীয় বর্গা বা মানসিক দাসত্ব পত্তনি বানচাল করে মুক্ত পৃথিবীর সাথে কাতার বাঁধা, যার স্বপ্ন একদিন দেখেছিলেন বার্মার উ-নু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, জুগোস্লাভিয়ার জোসেফ ব্রোজ টিটো, শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েকে, পাকিস্তানের শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা ভারতের পণ্ডিত নেহরু। এই নিরপেক্ষ রাষ্ট্রনেতারা চেয়েছিলেন দুই পরাশক্তি বলয় থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করতে। আজকের এই অনৈকিত কাজ কারবার দেখলে তারা আরো শক্তি নিয়ে জোট নিরোপেক্ষতার আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তাদের আন্দোলনের মুখে ছাই দিয়ে আমেরিকা কোরিয়া যুদ্ধ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এখনকার পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও অনৈতিকতা আরো বেরেছে। ডলার সাম্রাজ্যবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাথা উঁচু করছে ‘বিট-কয়েন’ সাম্রাজ্যবাদ এবং সাইবার-সাম্রাজ্যবাদ। কোরিয়ার কিম জং কি এমনিই এত ক্ষ্যাপা পশ্চিমা জগতের ওপর? পশ্চিমা পৃথিবী একদিন এভাবেই ‘উন্মাদ’ আখ্যা দিয়েছিল হিটলারকে। উন্মাদ আসরের দোসর খেতাব পেয়েছিল বেনিতো মুসোলিনি আর জাপানের জেনারেলিশিমো মার্শাল তোজো। তাদের ওই মনগড়া খেতাবকে ইতিহাস পরিত্যাগ করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে পৃথিবী আসলেও বিপদমুক্ত হয়নি। বরং এক তরফা বিশ্ব-ইজারা পেয়েছে পশ্চিমা রাষ্ট্রসঙ্ঘ। ইউক্রেইনের রণাঙ্গনে সেই অমোঘ সত্যটিই আবার প্রমাণিত হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : [email protected]