ছাত্র নেতাদের রাজনৈতিক সফলতা নির্ভর করছে সততা ও সহনশীলতার ওপর

আতিকুর রহমান নয়ন

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবারmzamin

facebook sharing button

মিথ্যা বলা যেন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যেমন কথায় কথায় মিথ্যা বলতেন, তার দলের নেতাকর্মীরাও অনবরত সেই মিথ্যার অনুশীলন করতেন। মিথ্যার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে তারা দেশের শত কোটি টাকাও খরচ করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তরুণ প্রজন্ম সহজেই সেই অসত্য আর অপতথ্য বুঝতে এবং অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছে। জুলাই-আগস্টে এসে তরুণ সমাজ অপতথ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মিথ্যার জালকে ছিন্নভিন্ন করে এক সাগর রক্ত এবং সহস্র প্রাণের বিনিময়ে সত্যের জয় ছিনিয়ে এনেছে।
মিথ্যা এক ধরনের প্রতারণা। তরুণ প্রজন্ম এটি খুব ভালোভাবে ধরতে পারে। অসঙ্গত বা অবান্তর কিছু একটা বলে বা করে তা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ভিন্ন কথা বা কাজ দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা, তথা ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র কৌশল এখন মোটেই কার্যকর নয়। শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে ‘নাটক কম করো পিও’- প্রবাদটি তেমন শঠতার পরিপ্রেক্ষিতেই সৃষ্ট।
জুলাই-আগস্টের মাত্র কয়েক দিনের আন্দোলনে সূচনা এবং চূড়ান্ত পরিণতির মাঝের সময়টাতে অনেকগুলো ধাপ ছিল। সেখানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের মাঝেও নানা মতভেদ তৈরি হয়েছিল। তবে জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার কাছে তাদের মতভেদ ম্লান হয়ে সঠিক পথেই এগিয়েছে আন্দোলন। সে সময় যদি কোনো কারণে ফ্রন্ট লাইনে থাকা ছাত্র নেতারা আন্দোলন থেকে সরেও যেতেন, যেমনটা তারা ডিবি অফিস থেকে ঘোষণাও দিয়েছিলেন, আন্দোলন তার নিজ গতিতে ঠিকই এগিয়ে যেত। কারণ, একটা সময়ে আন্দোলনে কে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেটা ছাত্র-জনতার কাছে কোনো মুখ্য বিষয় ছিল না। বরং গণহত্যার বিচার এবং স্বৈরাচারের পতনই সবার একমাত্র বাসনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এখন সেই আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে চলছে টানাটানি। আন্দোলনে ছাত্র নেতাদের নেতৃত্বের অবদান কেউই অস্বীকার করে না, করতে পারবেও না। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো ছাত্র নেতাদের প্রতি অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছে। ছাত্র নেতারাও স্বীকার করেছেন এ আন্দোলন ছিল দলমত নির্বিশেষে সকলের। তবে সম্প্রতি ছাত্রদের রাজনৈতিক দল ঘোষণাকে সামনে রেখে কাদা ছোড়াছুড়ির কিছু ঘটনা ঘটছে- যেটা দেশের পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই ইঙ্গিত বহন করে।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কিছু মন্তব্য বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে সরকারে থাকা নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে ১/১১ এর সঙ্গে তুলনা করে সমালোচিত হয়েছেন।
অন্যদিকে, সমন্বয়ক সারজিস আলম জুলাই আন্দোলনে বিএনপি’র ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। একটি গণমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেছেন, বিএনপি হাসিনা পতনের আন্দোলনে একমত ছিল না। অন্যদিকে, ২১শে জুলাই বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ফেসবুক পেজে লাইভে এসে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে সকলকে চূড়ান্তভাবে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আন্দোলনে তাদের চার শতাধিক নেতাকর্মী নিহতের সংখ্যাও উল্লেখ করেছে বিএনপি। ফলে আন্দোলন সফল হওয়ার ছয় মাস পর এসে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনরত একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিচ্ছে। একইসঙ্গে তৈরি হচ্ছে ছাত্র নেতাদের সততা ও নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্ন।
আরেক সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ’র সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়েও জনসাধারণের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যখন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময়, ঠিক তখন তার ভীতি সঞ্চারক বক্তব্য যা তার অনুসারীদের আইন হাতে তুলে নিতে উৎসাহ জোগায়- তা জনসাধারণের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এমন আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি না করে সরকারের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা তাদের ভবিষ্যৎ দল ও দেশের জন্যই মঙ্গলজনক।
গণ-অভ্যুত্থান দেশের মানুষকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সেখানে এখন সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম ধোঁয়াশা। ছাত্র নেতাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখার জন্য কথা ও কাজে সততা ও সহনশীলতার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় যদি তারা পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুসরণ করে, তবে তাদের অবদান ম্লান হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ তার রাজনীতি সচেতন নতুন প্রজন্ম হারাবে।
লেখক: গণমাধ্যম গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here