নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ক্ষমতাসীনদের দাপট ততই বাড়ছে। যেখানে নির্বাচনের আগে অবাধ ও স্বাধীন রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন সেখানে তারা উল্টো কাজটি করছে। বিরোধীদের নির্বাচনে যেতে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করছে। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচন তারই প্রমাণ। বিনাভোটে ২৫ জনসহ ৪৯ চেয়ারম্যান পদে একতরফা নির্বাচনী খেলায় জয়লাভ করেছেন তারা। একরকম বিরোধী প্রার্থীহীন এই নির্বাচনে তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে।
উল্লেখ্য, জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে সেই পুরনো আইয়ুবি মৌলিক গণতন্ত্র ধারায়। সেকালে মেম্বার ছাড়া কেউ ভোট দিতে পারত না, এবার মেম্বার ও আরো পদাধিকারী ভোটার। সবাই জানে ও বোঝেন, নৌকা মার্কার প্রার্থী মানেই বিজয় নিশ্চিত। তারপরও এসব কঠিন বলয়কে অতিক্রম করে ছয়জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছেন তিনজন। সবেধন নীলমণি জাতীয় পার্টি থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন একজন। এই নির্বাচনের আগে গাইবান্ধার উপনির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে কী দেখলাম আমরা? ক্ষমতাসীন প্রার্থীর পক্ষে সমস্ত অন্যায় ও অপকর্ম সত্ত্বেও আওয়ামী নেতাদের অবাধ সমর্থন। সেখানে নির্বাচন কমিশন প্রামাণ্য ও প্রকাশ্য জবরদখলের পর ভোট বন্ধ করে দেয়। সমস্ত ন্যায়-নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইলেন। অতীতের সব নির্বাচনে যে অপকৌশল অবলম্বন করেছিলেন এখানেও তাই তারা করতে চেয়েছিলেন। অন্যায় করতে করতে মানুষের নাকি ন্যায়বোধ লোপ পায়। তাদের দাবি হলো- ক্ষমতাসীন দল যেভাবে চাইবে সেভাবেই নির্বাচন হতে হবে। এই প্রথমবারের মতো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন একটু ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত নিলো। তাতেই তারা মহা ক্ষিপ্ত হয়েছে। তারা সিইসির পদত্যাগ চেয়েছেন। গাইবান্ধায় বিক্ষোভ হয়েছে।
নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই অনিয়মের খবর আসছিল। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা অন্যান্য প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেন। নিজেরা গোপন ভোটকক্ষে ঢুকে ভোট দিয়ে দেন। নির্বাচন কমিশনের লোকেরা সকাল থেকেই সিসি ক্যামেরায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হচ্ছিল সেগুলোর নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া হয়। ওদিকে দুপুর ১২টা নাগাদ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া সব প্রার্থী নির্বাচন পরিত্যাগ করেন। বিকেলের দিকে নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে দেয়। এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। তারা ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে প্রত্যক্ষ করে ভোট বন্ধ করে দেয়ার সমালোচনা করে। তারা নিজেদের অধ্যায়গুলো দেখতে চায় না।
এতদিনে ডিজঅর্ডার বিকামস দ্য অর্ডার। নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা- স্থানীয় প্রশাসন, ডিসি-এসপিরা ভুলেই গেছেন যে, তারা সরকারের লোক নন, জনগণের লোক। ২০১৪ ও ২০১৮-এর বোগাস নির্বাচনের পর এরা ধরেই নিয়েছে যে, অবৈধ ব্যবস্থাই বৈধ। অতীতে অনিয়মের কারণে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন বাতিল হয়েছে- এরকম জানা যায়নি। প্রশাসন ও পুলিশ যেভাবে নির্বাচন করিয়ে দিয়েছে সেভাবে নির্বাচন করতে চায় তারা। কিন্তু সময় বদলেছে, পরিবেশ বদলেছে। মানুষ দেখতে দেখতে পশুখাদ্য খেয়েছে। তবে তারা পশু হয়ে যায়নি। মানুষগুলো এখনো মানুষ আছে। যখন ঝড় আসবে তখন সব তছনছ হয়ে যায়। এই গেল নির্বাচনের বেহাল অবস্থা। গাইবান্ধার নির্বাচন বন্ধের ঘোষণা মানুষের মনে সাহস জুগিয়েছে। এখন তারা প্রশ্ন করছে- ২০২৪ সালের নির্বাচনও কি এমন হবে, তারা করতে পারবে? এই নির্বাচনের মাধ্যমে ইসির একটি শিক্ষা হয়েছে। তারা দেখেছে, ডিসি-এসপিরা এমনকি প্রিজাইডিং অফিসাররাও নির্বাচন কমিশনকে পাত্তা দেয় না। আর রাজনৈতিক দলের জন্য আবারো শিক্ষা হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সঠিক হতে পারে না।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে কিভাবে প্রহসনে পরিণত করে তা দেখা গেল। এবারে আসুন জনগণের মৌলিক অধিকার প্রশ্নে। সে দিন ময়মনসিংহে বিএনপির জনসভা ছিল। মানুষের ঢল নেমেছিল। সভার আগের দিন রাতে বিএনপিকর্মীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে আওয়ামী বাহিনী। সভার দিন অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর ঘটে আজব ঘটনা। ময়মনসিংহ শহরকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আশপাশের জেলাগুলো থেকে ময়মনসিংহের পথে বাস চলেনি। এমনকি অটোরিকশার মতো যানও বিভাগীয় শহরে ঢুকতে পারেনি। অন্য জেলা থেকে বিএনপির গণসমাবেশে যাতে লোকজন অংশ নিতে না পারে সে জন্যই এ অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। পথে পথে বাধা, কখনো পুলিশের তল্লাশি, আবার কখনো বা আওয়ামী কর্মিবাহিনীর লাঠি হাতে মহড়া।
বিগত ১৫ বছরে একই স্টাইলে গণসমাবেশ পণ্ড করার প্রয়াস চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। জোরপূর্বক মালিকদের রাস্তায় বাস নামাতে দেয়া হয়নি। শোনা যায়, বাসমালিকদের এ জন্য ভর্তুকির টাকাও দেয়া হয়। কথায় বলে- খলের যুক্তির অভাব হয় না। এখন যখন প্রশ্ন উঠছে তখন বাসমালিকরা বলছেন- ভাঙচুরের শঙ্কা থেকেই এমন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তারা। ওই দিন ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানি ও অপমানের সম্মুখীন হয়েছেন। সমাবেশে যাচ্ছেন- এমন সন্দেহ থেকে গফরগাঁওয়ে এক শ্রমিককে কুপিয়ে জখম করার ঘটনা ঘটেছে। এর আগের রাত থেকেই ময়মনসিংহের সাথে আশপাশের জেলার বাস চলাচল একরকম বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে কোনো বাস ওই দিন ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি।
একইভাবে জামালপুর, নেত্রকোনা, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল থেকেও ময়মনসিংহের পথে বাস চলাচল ছিল নিষিদ্ধ। নাবালকও বোঝে যে, বিএনপির জনসভায় মানুষ যাতে আসতে না পারে সে জন্য এই জঘন্য কাজটি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ত্রিশাল বাজার পর্যন্ত সড়ক দখলে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। কোথাও লাঠি হাতে আবার কোথাও সড়কে বসে থেকে। এ সময় তারা যানবাহন তল্লাশি করে। চালককে মারধর করে। যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ করে। সড়কে লাঠিসোটা নিয়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের অবস্থানের বিষয়ে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট ওসিদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন, কোনো ঘটনা ঘটেনি। সড়কে কাউকেই অবস্থান নিতে দেখেননি। একেই বলে- চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে বন্ধ। ময়মনসিংহের অভ্যন্তরীণ যানবাহনও চলতে দেয়া হয়নি। কয়েকটি অটোরিকশা চলেছে, তারা অনেকগুণ ভাড়া নিয়েছে।
শহরের প্রতি মোড়ে মোড়ে তল্লাশি বসানো হয়। জেলা পুলিশ সুপার জানান, সমাবেশে বাধা দেয়ার উদ্দেশে পুলিশ তল্লাশি চৌকি বসায়নি। এটি নিয়মিত মহড়ার অংশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন- নাগরিকদের নির্বোধ ভাবলেই কেবল এমন মন্তব্য করা যায়। বাস বন্ধ থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের অগ্রযাত্রা বন্ধ থাকেনি। এদের অনেকেই ট্রলারে করে ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে। অবশ্য পথে পথে বাধা সত্ত্বেও ময়মনসিংহের পলিটেকনিক মাঠে বিএনপির জনসমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল আন্তরিক ও আগ্রহোদ্দীপক। মাঠ ছিল কাণায় কাণায় পূর্ণ। সড়কপথে বাধা দেয়া হবে জেনে অনেকে ট্রেনে আসেন। সকালের বাধা অতিক্রম করার কৌশল হিসেবে কয়েক শ’ নেতাকর্মী পলিটেকনিক মাঠে রাতেই অবস্থান নেন। তারা কেউ কেউ পাটি বিছিয়ে ঘুমান আবার কেউ কেউ আড্ডা দিয়ে রাত কাটিয়ে দেন।
বিএনপি মহাসচিব এ অবস্থাকে হরতাল বা কারফিউয়ের সাথে তুলনা করেন। এভাবে পথে পথে ও পদে পদে বিরোধী শক্তিকে বাধা দেয়ার কৌশল করেই অতীতে তারা সমাবেশ পণ্ড করার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের কথা মনে করুন। বিএনপির প্রতিটি সমাবেশই ছিল যেন হরতাল বা কারফিউ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ ভীতি, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধা দিয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তকরা বলেন, কোনো একটি সমাজকে এভাবে ক্ষণিকের জন্য প্রতারিত করা যায়; কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য প্রতারিত করা যায় না, ভীতি প্রদর্শন করা যায় না। আজকে আগামী দিনের লড়াই সম্পর্কে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক- ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]