একই দিনের (২৩ জানুয়ারি) পত্রিকায় ছাত্রলীগের চারটি খবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শিক্ষার্থীকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বলেছেন, শিবির সন্দেহে এই কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই উপগ্রুপের মধ্যে মারামারির জের ধরে অবরোধের ডাক দিয়েছে সংগঠনের একাংশ। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় বহিষ্কৃত হয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাসহ তিনজন। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাসকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এক আসামি।
এই চার ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র ভিন্ন হলেও একটি অভিন্ন শব্দ আছে—‘মারামারি’। মারতে মারতে একজনকে মেরেই ফেলেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। অথচ তিনিও ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও মারামারি করেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দিতে হাতুড়ি দিয়ে পেটান, ডিশের তার দিয়ে নির্যাতন করেন। তাও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে! দেশের মানুষ যখন সাগ্রহে মুজিব বর্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করতে অপেক্ষা করছেন, তখন ছাত্রলীগ ভিন্ন ধরনের অনুশীলন করে যাচ্ছে। এই অনুশীলনের নাম মারামারি। যার সঙ্গেই মতের অমিল হবে, তাকে পিটিয়ে ঠান্ডা করা হবে। এই মারামারিতে যখন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার নাম আসে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ব্যাধিটি অনিরাময়ের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের ‘দখলে’। তারা চাইলে বিরোধী ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে থাকতে পারে, না চাইলে পারে না। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ছাত্রলীগের হাতে তিনি বহুবার মার খেয়েছেন। তাঁর প্রথম ‘অপরাধ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাঁকে ভিপি নির্বাচিত করেছেন। দ্বিতীয় অপরাধ, তিনি একসময় ছাত্রলীগ করলেও তাদের অবাধ্য হয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন করে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করেছেন। ছাত্রলীগের রাজত্বে এই ‘অবাধ্য’ আচরণ কীভাবে সহ্য করবেন তাঁরা?
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আইন থাকে, ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্য একটি আচরণবিধি থাকে। কিন্তু ক্যাম্পাসে এখন সব আইন ও আচরণবিধি অকার্যকর। একমাত্র কার্যকর ছাত্রলীগের আইন। তারা যা বলবে, সেটাই সবাইকে মানতে হবে। তাদের কথার বাইরে গেলেই শাস্তি পেতে হবে। সে হোক নির্বাচিত ভিপি কিংবা তাদের সন্দেহভাজন শিবিরকর্মী।
ছাত্রলীগের জহুরুল হকের নেতা-কর্মীরা শিবির সন্দেহে যাঁদের পিটিয়েছেন, তাঁরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। আমরা জানি, ডাকসু ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের তরফে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ওই চার শিক্ষার্থী সাংগঠনিক কোনো তৎপরতা চালিয়েছেন, এ রকম কোনো প্রমাণ ছাত্রলীগ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও দিতে পারেনি। তারপরও প্রক্টর বলেছেন, শিবির সন্দেহে চার শিক্ষার্থীকে থানায় দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন শিক্ষক হয়ে কীভাবে অভিযোগের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া চার শিক্ষার্থীকে থানায় হস্তান্তর করলেন?
এ ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেছেন, ওই চার ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় দিয়েছে হল প্রশাসন। গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের অতিথিকক্ষে ‘গেস্টরুম কর্মসূচি’ শেষে রাত দুইটা পর্যন্ত ওই শিক্ষার্থীদের পেটান ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। পরে হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে তাঁদের রাজধানীর শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। গতকাল বুধবার বেলা দেড়টার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগের ২২ জন নেতা-কর্মী কারাগারে আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও জমা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্থায়ীভাবে তাঁদের বহিষ্কার করেছে। আবরারের হত্যার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। একইভাবে যাঁরা আবরার হত্যার জন্য দায়ী, তাঁদের পরিণতিও কম বেদনার নয়। মা-বাবা তাঁদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন মানুষের মতো মানুষ হবে, এই অভিপ্রায়ে। কিন্তু তাঁরা খুনি হলেন। আমরা আশা করেছিলাম, আবরার হত্যার দায়ে নেতা-কর্মীরা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর অন্তত ছাত্রলীগের বোধোদয় হবে। তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না। এর আগে চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলামের কাছে চাঁদা দাবি করেছিলেন। ছাত্রলীগে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ভারমুক্ত হয়েছেন।
কিন্তু নেতা বদলালেও যে ছাত্রলীগের চরিত্র বদলায়নি, তার প্রমাণ জহুরুল হক হলের ঘটনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির নয়, ছাত্রলীগই ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মোট ১১টি গ্রুপ-উপগ্রুপ আছে। এর মধ্যে ৯টি গ্রুপ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। আর দুটি হলো শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী। একটির নাম ‘বিজয়’, অপরটি ‘চুজ ফ্রেন্ড উইথ কেয়ার’ (সিএফসি)। গত পাঁচ বছরে অসংখ্যবার তারা সংঘর্ষ ও মারামারিতে লিপ্ত হয়েছে। গতকাল ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সিএফসির এক কর্মীকে মারধর করেন বিজয়ের কর্মীরা। এর জের ধরে বিকেল পাঁচটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হলে গিয়ে বিজয়ের দুই কর্মীকে মারধর ও এক কর্মীকে কুপিয়ে জখম করেন সিএফসির নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হকের পদত্যাগের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেয় ‘বিজয়’ পক্ষ। একই সঙ্গে ঝাড়ুমিছিলের কর্মসূচি নিয়েছে তারা। কার বিরুদ্ধে এই ঝাড়ুমিছিল? ছাত্রলীগের দুই উপদলের এক উপদলের বিরুদ্ধে।
‘এই ছাত্রলীগ লইয়া আমরা কী করিব?’
সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]