বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলায় ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় এক যুবকের বাবার জানাজায় অংশ নেওয়ার একটি ছবি দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঐ যুবক বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একটি উপজেলার যুগ্ম আহবায়ক।
জানাজার সময়ও ডান্ডাবেড়ি না খোলার বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ঘটনাটিকে বর্বরতা আখ্যা দিয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই ঘটনা সভ্যতার জন্য হানিকর। কোনও সভ্য সমাজে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে না বলেও তারা মন্তব্য করছেন।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জেল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যেভাবে ডান্ডাবেরি পরিয়ে দিয়েছে, তারা সেভাবেই জানাজায় হাজির করেছে।
“ঐ ডান্ডাবেরির চাবিও আমাদের কাছে দেওয়া হয় নি। যে কারণে ডান্ডাবেরি খোলা সম্ভব হয়নি”, জানাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
সেদিন কী ঘটেছিল?
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গত ২০শে ডিসেম্বর মো. নাজমুল মৃধাকে তার বাড়ির সামনে থেকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে তাকে একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠায় আদালত।
গত শুক্রবার রাতে নাজমুলের পিতা মোতালেব হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশালের একটি হাসপাতালে মারা যান।
পিতার মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নিতে আইনজীবীর মাধ্যমে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করে নাজমুলের পরিবার।
পরে তাকে পাঁচ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন আদালত। গত শনিবার মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী গ্রামে জানাজায় অংশ নেন নাজমুল।
সেই জানাজায় অংশ নেওয়ার একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায়ই জানাজায় অংশ নেন ঐ যুবক। এসময় তার হাতকড়া খুলে দেয়া হলেও ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি।
পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার সাইদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জেলখানা থেকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থাতেই দেওয়া হয়েছিলো। ওটার চাবি বা লক সিস্টেম সেটা আমাদের কাছে কখনোই থাকে না। এটা থাকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। ওরা যেভাবে আমাদের কাছে দিয়েছে সেভাবেই তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে।”
‘আমাদের দায়িত্ব ছিলো শুধুমাত্র নিরাপত্তা দেয়া। আমরা শুধু সেই নিরাপত্তাই দিয়েছি। ওরা আমাদের যেভাবে দিয়েছে, তাকে সেভাবেই পৌঁছে দেয়া হয়েছে”, জানিয়েছেন তিনি।
যে কারণে এত সমালোচনা
আটক ছাত্রদল নেতা নাজমুল মৃধাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো মাত্র ৫ ঘণ্টার জন্য। যে কারণে জানাজার নির্ধারিত সময়ের আগেই সংক্ষিপ্ত একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পিতা মোতালেব হোসেনের।
প্রথম জানাজায় অংশগ্রহণ শেষেই পটুয়াখালী কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় নাজমুলকে। পরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হয় তার পিতার মরদেহ।
এই জানাজায় অংশগ্রণের যে ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেই ছবিটি নিয়ে বিবিসির সাথে কথা হয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের।
মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বিবিসিকে বলেন, “এই ঘটনা এই বারই প্রথম না। আগেও দু’একবার ঘটেছে। এটা এক ধরণের বর্বরতা, এবং সভ্যতার জন্য হানিকর। কোনও সভ্য সমাজে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে না। আমরা এ জন্য মর্মাহত এবং দুঃখিত।”
“আমরা মনে করি সরকার তার দায়িত্ববোধ থেকে, তার নীতিবোধ ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে”, বলছিলেন মি. ফয়সাল।
এর আগেও এমন কিছু ঘটনার উদাহরণ টানেন সরকারপন্থী আইনজীবী মি. খুরশীদ আলম খান।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “প্যারোলে আসলে উচিত ছিলো ডান্ডাবেড়িটা খুলে দেওয়া। সম্ভবত তাদের পারমিশন ছিলো না। প্যারোলে আসলে অনেক শর্ত থাকে। সেগুলো পূরণ করতে হয়।”
“সে হয়তো জেলখানায় ডাণ্ডাবেড়ি অবস্থায় ছিলো, হয়তো তাকে ঐ অবস্থায় নিয়ে আসা হইছে। অনেক সময় ল সঠিকভাবে কাজ করে না”, বলছিলেন মি. খান।
আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বিবিসিকে বলেন, “এ ধরনের ঘটনা তাকে পরিবার ও সমাজের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করে। এতে করে তার সম্পর্কে এক ধরণের ধারণা দেওয়া হয় সে কত বড় অপরাধী। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।”
“সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের ক্ষেত্রে একটা বিধান আছে। কিন্তু অভিযুক্ত আসামীর ক্ষেত্রে এমন কোনও বিধান নাই”, বিবিসিকে বলেন তরুণ এই আইনজীবী।
ডান্ডাবেড়ি কাদের পরানো যায়?
বাংলাদেশ জেল কোডের ১৯ নম্বর অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী কারাগারের অভ্যন্তরে ‘কারা অপরাধের’ জন্য গুরুতর শাস্তি হিসেবে ৩০ দিনের জন্য ডান্ডাবেড়ি পরানোর আদেশ দেওয়ার বিধান রয়েছে । তবে এই শাস্তি আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।
বিচারাধীন মামলার আসামি বা রাজবন্দীদের এ ধরনের দণ্ড দেয়ার কোনও বিধান নেই।
জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ খেয়াল খুশিমতো বিচারাধীন বন্দি এবং আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরালে তা বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সরাসরি লঙ্ঘন হবে বলেও জানাচ্ছেন আইনজীবীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বিবিসিকে বলেন, “যে ফৌজদারি আইন আছে, সেটা হয়েছিলো সিপাহী বিদ্রোহের পরে। লক্ষ্য ছিলো সিপাহীদের দমন করা, এবং ভারতীয়দের সোজা রাস্তায় রাখা।”
“এত বছর পরও যে সেই আইন এখনো প্রচলিত আছে এবং এখানে যারা আইন প্রণেতা হয়েছেন তারা যে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে সচেতন নন এবং এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেন নাই এটা দু:খজনক”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. ফয়সাল।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতীত কাউকে কোনও ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না ।
আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, যে সমস্ত আসামিদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা শৃঙ্খলা জড়িত এবং যাদের মুভমেন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ আছে এবং যারা ‘হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার’, অর্থাৎ সুযোগ পেলে পালিয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রেই কেবল ডান্ডাবেড়ি পরাতে হয়।
পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “পটুয়াখালীর এই ঘটনাটা মানবাধিকারের দৃষ্টিতেও ঘৃণিত এবং তাকে সামাজিকভাবে এবং পারিবারিকভাবেও চরম হেনস্থা করা হচ্ছে।”
আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলছেন, “খুব যদি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী থাকে। তাদের জন্য ডান্ডাবেড়ি ছাড়া উপায় থাকে না। যাদের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের এলিগেশন থাকে তাদেরকে ডান্ডাবেড়ি পড়ানো হয়।”
তবে এর পাশাপাশি মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করা উচিত বলেও মনে করেন মি. খান।
BBC BANGLA