চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের মানুষের পকেটের ব্যয় বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্য রাষ্ট্রীয় আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট পূরণে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এই তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির দক্ষিণ–পূর্ব অঞ্চলের ১১টি দেশ নিয়ে ‘হালনাগাদ ২০১৯’ তথ্য প্রকাশ করেছে তারা।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পরিধি বৃদ্ধি ও আর্থিক সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। প্রজনন মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা—সেবার ক্ষেত্রে এই চারটি বিষয়ে ১৬টি সূচক ব্যবহার করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অন্যদিকে আর্থিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে নিঃস্ব হয়ে পড়া ও আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়—এই দুটি সূচককে ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেবা পরিস্থিতি ও আর্থিক সুরক্ষা দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি
দেশের মধ্যে শুধু পূর্ব তিমুরের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। মন্ত্রণালয় মূলত সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যপদ্ধতি শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হলে সব মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলতে প্রত্যেক নাগরিক প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পাবে। আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে কেউ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে না। আবার সেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে কেউ নিঃস্ব হবে না বা তার অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে যাবে না।
আর্থিক সুরক্ষা পরিস্থিতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশ সরকার জিডিপির মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্য খাতে। আর চিকিৎসাসহ স্বাস্থ্যসেবা খাতে যত খরচ হয়, তার ৭২ শতাংশ যায় ব্যক্তির পকেট থেকে। বাকি ২৮ শতাংশ খরচ করে সরকার, এনজিও ও দাতা সংস্থা।
ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়লে, দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত মানুষ চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে অথবা চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের হার কমে প্রায় ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিম্নমানের আর্থিক সুরক্ষার ইঙ্গিত দেয়।
ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কেন বাড়ছে—জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬০ শতাংশের বেশি যায় ওষুধের পেছন, বেশি দামের ওষুধের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। হাসপাতালে অবস্থানের খরচ ও যাতায়াত খরচও বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষকে ‘আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের’ চাপ সামলাতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে একটি পরিবার তার মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ ব্যয় করে শুধু স্বাস্থ্যের পেছনে। অগ্রাধিকার ঠিক করে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে সংস্থাটি মত দিয়েছে।
সেবা পরিস্থিতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৬টি সূচকের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ শতাংশ সেবা নিশ্চিত করতে পেরেছে। সূচকগুলো হচ্ছে: পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভধারণ ও প্রসবসেবা, শিশুদের টিকা, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা, যক্ষ্মার চিকিৎসা, এইচআইভি/ এইডসের রোগীদের অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল প্রাপ্তি, মশারি বিতরণ, মৌলিক পয়োনিষ্কাশন সুযোগ, খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা, রক্তচাপ, জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্তকরণ পরীক্ষা, ধূমপায়ীর হার, হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা, অত্যাবশ্যক ওষুধপ্রাপ্তির সুযোগ এবং স্বাস্থ্যনিরাপত্তা।
সূচকের মান ০ থেকে ১০০ শতাংশ হিসাবে ধরা হয়েছে। ১০০ শতাংশের অর্থ হচ্ছে, সব সেবা পূর্ণমাত্রায় সব মানুষকে দেওয়া। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ১০০-তে ১০০ পেয়েছে মশারি বিতরণ সূচকে। তিন পার্বত্য জেলাসহ ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩টি জেলায় মশারি বিতরণ কর্মসূচি আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার। জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্তকরণ সূচকে ‘০’ পেয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে হালনাগাদ তথ্য নেই বলেই মনে হয়, থাকলে পরিস্থিতি আরও উন্নত দেখাত। এইচআইভি, যক্ষ্মা ও নিউমোনিয়া সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভালো। অন্যদিকে জরায়ুমুখ ক্যানসার নিয়ে সরকারের অনেক কাজ আছে, এই সূচকে শূন্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।
পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে
২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্র তৈরি করে। ২০১২-২০৩২ সাল মেয়াদি ওই কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশ করা হবে। তখন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪ শতাংশ। এরপর ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ৬৭ শতাংশ। আর বর্তমানে ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় দিন দিন বাড়ছে, তা কমার কোনো লক্ষণ নেই।
ওই কৌশলপত্র তৈরির সময় স্বাস্থ্য ব্যয়ের ২৬ শতাংশ বহন করত সরকার। বলা হয়েছিল, ব্যয়ে সরকারের অংশ ক্রমেই বাড়িয়ে ২০৩২ সালে ৩০ শতাংশ করা হবে। বাস্তব পরিস্থিতি অন্য রকম দেখা যাচ্ছে। মোট ব্যয়ে ক্রমেই সরকারের অংশ কমছে। বর্তমানে তা ২৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একধরনের উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায় ওষুধের পেছনে। ওষুধের দামের ওপরে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ তিনি আরও বলেন, সরকার হাসপাতাল দিচ্ছে, পর্যাপ্ত জনবল দিচ্ছে না। প্রচুর মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠলেও মানসম্পন্ন চিকিৎসাশিক্ষা হচ্ছে না। রোগীরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে, এক চিকিৎসকের কাছ থেকে অন্য চিকিৎসকের কাছে দৌড়ায়। এতে খরচ বাড়ে। অসংগতিগুলো দূর করলেই ব্যক্তির খরচ অনেক কমে যাবে।