চলতি অর্থবছরে চাল আমদানি করেনি সরকার। আবার বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে গম আমদানিও কমেছে। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ফলে এর বড় একটি চাপ পড়েছে খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। ছয় মাসের ব্যবধানে এটি কমেছে সাড়ে তিন লাখ টনের বেশি। এ পরিস্থিতিতে চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে কিছু পরিমাণ হলেও আমদানি করা দরকার ছিল।
তাদের ভাষ্য, সরকারিভাবে দেশে চালের রেকর্ড উৎপাদনের কথা বলা হলেও ভরা মৌসুমে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। রমজানের বাকি আর মাত্র দুই মাস। প্রতি বছরই এ সময় সরকারি সহায়তার আওতা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু খাদ্যশস্যের মজুদ কমে আসায় এবং চাল আমদানি না করার কারণে ব্যবসায়ীরা বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন। আমদানির যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা বাস্তবায়নেও সময় লাগবে। এছাড়া উৎপাদন, চাহিদা ও ঘাটতির প্রকৃত তথ্য বের করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। কিছু পরিমাণ চাল আমদানি করা দরকার ছিল। কারণ উৎপাদন ও চাহিদা যদি সমান থাকে তাহলে সঞ্চয় থাকল না। যদি চাহিদা অনুপাতে উৎপাদনও হয় তাহলে সঞ্চয়ের জন্য কিছু চাল আমদানি প্রয়োজন। কারণ এর আগে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে। এখন চালের ভরা মৌসুম। অথচ চালের দাম বাড়ছে। কিছু চাল আমদানি হলে এ সমস্যা দেখা দিত না। আগামী মার্চে বাজার কেমন থাকে তাই এখন ভাবনার বিষয়। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা সব খোঁজখবরই রাখেন। সুযোগ বুঝে এ কারণে তারা বাড়িয়ে দিয়েছেন কিনা তাও ভাববার বিষয়।’
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১১ জানুয়ারি সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৬ লাখ ২৬ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ২৮ হাজার টন এবং গমের মজুদ ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার টন। যদিও চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ গত জুলাইয়ে খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৯ লাখ ৮৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৭ লাখ ৬০ হাজার টন এবং গম ২ লাখ ২৪ হাজার টন। এরপর সেপ্টেম্বরে খাদ্যশস্যের মজুদ প্রায় দুই লাখ টন কমে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৭০ হাজার টনে। অর্থাৎ গত ছয় মাসের ব্যবধানে খাদ্যশস্যের মজুদ কমেছে সাড়ে তিন লাখ টনের বেশি। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারিতেও খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৯ লাখ ৫৭ হাজার টন। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায়ও খাদ্যশস্যের মজুদ কম রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন।
মাত্রই শেষ হলো আমন মৌসুম। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরু থেকে বাজারে আমন ধানের চাল আসতে শুরু করে। এরপর জানুয়ারিতে পুরোদমে বাজারে আমন চালের সরবরাহ দেখা যায়। তবে গত সপ্তাহ থেকে মিল, পাইকারি ও খুচরা—প্রায় সব পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৬ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রি-২৮ চাল প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) প্রায় ২০০-৩০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। মিনিকেট বস্তায় ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। প্রতি কেজি নাজিরশাইল মানভেদে ৬৫-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগেও ছিল ৬২-৭৫ টাকা। স্বর্ণা ও পাইজাম চালেও দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা।
যদিও খুচরা পর্যায়ে মিনিকেট ৪ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি কেজি ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ব্রি-২৮ ও পাইজাম ৪ টাকা বেড়ে ৫৮-৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫-৮০, কেজিতে ২-৪ টাকা বেড়ে স্বর্ণা ৫০-৫২ এবং পোলাওয়ের চাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকায়।
যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি আমন মৌসুমে মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৯৮ টন। যা বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। গত বোরো মৌসুমেও রেকর্ড চাল উৎপাদন হয়েছিল বলে সরকারিভাবে দাবি করা হয়েছে।
কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী গমের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। পাশাপাশি ডলার সংকট বাড়িয়ে তোলে এলসি বিড়ম্বনা। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে গম আমদানি। আর এর প্রভাব পড়ে চালের ওপর। যদিও চলতি অর্থবছরে কোনো চাল আমদানি করেনি সরকার। বাজারে দাম বাড়ার পেছনে আমদানি না করার এ সিদ্ধান্তকেই দায়ী করছেন অনেকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে গতকাল পর্যন্ত গম আমদানি হয়েছে ২৬ লাখ ৫২ হাজার টন। গত অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয় ৪৯ লাখ ৩১ হাজার টন। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল এবং ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি করা হয় ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ৯ লাখ ৮৮ হাজার টন চাল এবং ৪০ লাখ ১২ হাজার টন গম আমদানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৭ লাখ ২ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল এবং ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার টন গম আমদানি করা হয়।
যদিও গত নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘জিআইইডব্লিউএস কান্ট্রি ব্রিফ বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের চাল ও গম আমদানির পূর্বাভাস দেয়া হয় মোট ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল ও ৬১ লাখ টন গম।
খাদ্যশস্য আমদানি কমে গেলেও বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্যশস্য বিতরণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে মোট ৩০ লাখ ৯২ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এরই মধ্যে ১৪ লাখ ৮ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়েছে। যার ১২ লাখ ৪ হাজার টন চাল ও ২ লাখ ৪ হাজার টন গম। গত অর্থবছরে সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়েছে ৩০ লাখ ৮ হাজার টন। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৭৭ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, আমন মৌসুমের সংগ্রহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সংগ্রহ শেষ হলে খাদ্যশস্যের মজুদ পর্যাপ্ত হয়ে যাবে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি আমন মৌসুমের শুরুর দিকে দুই লাখ টন আমন ধান, চার লাখ টন সিদ্ধ চাল ও এক লাখ টন আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে আরো দুই লাখ টন আমন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৬ হাজার টন ধান, ৩ লাখ ৬৬ হাজার টন চাল ও ২৭ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে। এ সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান হোছাইনী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমন মৌসুমের সংগ্রহ চলছে। সরকারি গুদামে ১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ থাকলে নিরাপদ ধরা হয়। সে হিসাবে বর্তমানে মজুদ বেশি আছে। চাল আমদানি না করার কারণে বাজারে প্রভাব পড়ছে না। আমাদের ফলন ভালো হয়েছে। চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সোচ্চার রয়েছেন। তিনি সবাইকে নিয়ে খুব দ্রুত একটি সভা করবেন। আশা করছি দাম কমে আসবে।’
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আগামীকাল চালকল মালিকসহ খাদ্য বিভাগের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা ডেকেছে খাদ্য অধিদপ্তর। সেখানে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে একটি নির্দেশনা দেয়া হবে। এরপর সেই অনুযায়ী কাজ করা হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ তানভীর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বছর আমনের ভালো ফলন হয়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম রাতারাতি বেড়ে যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। চলতি মৌসুমে জেলার মিল মালিকদের থেকে ২৭ হাজার ৫২৪ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে এরই মধ্যে ২১ হাজার ৮৩৫ টন চাল খাদ্য গুদামে সরবরাহ করেছেন মিল মালিকরা। যা চাল সংগ্রহের মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ। মিলাররা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার চাল দিতে বেশি আগ্রহী। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় ধান সংগ্রহে কৃষকদের থেকে খুব একটা সাড়া মিলছে না।’
চাল আমদানি না করার বিষয়টিকে ‘অপরিপক্ব’ সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেন কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন। সার্বিক বিষয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। সরকারি মজুদ বাড়ছে না কমছে তা কিন্তু তারা নিয়মিত খবর রাখছেন। যখন মজুদ কমে আসতে শুরু করে তখন তারা একটা সুযোগ নিতে চান। চাল আমদানি একেবারেই না করা একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ গম আমদানি কমে গেছে। আর এর প্রভাব চালের ওপর পড়ছে।’
তবে বাজার অস্থিতিশীলতায় চাহিদা, উৎপাদন ও ঘাটতির বিষয়ে তথ্যগত সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তথ্য ও উপাত্তের যে সমস্যা তা সমাধান না হলে বাজারে অস্থিতিশীলতা বা অনিশ্চয়তা চলতে থাকবে। আমাদের প্রকৃত চাহিদা, উৎপাদন ও ঘাটতি কত তার যথাযথ তথ্য প্রয়োজন। কতটুকু মজুদ রাখতে হবে বা কখন আমদানি করতে হবে এসব বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য বা সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায়। এটা নিরসন করা দরকার। কৃষক তার দাম পাচ্ছেন না কিন্তু ব্যবসায়ীরা এ সময়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তারা যেন বাজারে আধিপত্য না করতে পারেন সেজন্য সরকার মজুদ থেকে চাল বাজারে ছাড়তে পারে।’
বনিক বার্তা