সরকারি কর্মচারী হিসেবে পুলিশ সদস্যদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। তবুও একশ্রেণির পুলিশ সদস্যের এ ধরনের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
টুরিস্ট পুলিশের খুলনা-বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে আছেন এই অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি)। তাঁর ছোট ভাই শৈলকুপা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান ঝিনাইদহ-১ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি পুলিশের পোশাক পরে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে গতকাল সোমবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা দিতে যান।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি-২৫ (১)–এ বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনোভাবে যুক্ত হতে বা কোনো প্রকারে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা করতে পারবেন না। বিধি–২৫ (৩)–এ বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী আইন পরিষদ নির্বাচনে কোনো প্রকার প্রচারণা অথবা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব প্রয়োগ অথবা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটি বিভাগীয়ভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান বাহিনীর পোশাক পরে এই কাজ করেছেন। এ ধরনের কাজ একদিকে বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (সাবেক আইজিপি) নুরুল হুদা আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, পোশাক পরে এভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া চাকরির আচরণবিধির সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন। একজন পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে এটা কোনো প্রত্যাশিত আচরণ নয়।
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার এমন কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা–সমালোচনা চলছে। তবে তাঁর বিষয়ে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক বিকেল ৪টায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে কতটুকু কী করল, সেটি যাচাই-বাছাই করে আইনের নিরিখেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, কর্তৃপক্ষের যদি মনে হয় যে তিনি চাকরির আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী কাজ করেছেন তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ বিষয়েও খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’
পরে রাত সাড়ে ১১টায় পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ইনামুল হক মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।’
কেবল অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামানই নয়, এর আগেও কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত হতে দেখা গেছে। চলতি বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্ত্রীর পক্ষে প্রচারে যোগ দিয়েছিলেন বরিশাল মহানগর পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার হামিদুল আলম। তাঁর স্ত্রী শাহাজাদী আলম বগুড়া-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। তখন অভিযোগ ওঠে, হামিদুল সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে স্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। পরে অবশ্য তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমন আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রচারে অংশ নেওয়ার খবর গণমাধ্যমে বের হয়। এর মধ্য গত বছরের ২০ নভেম্বর পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে ফুলের তোড়া নিয়ে দেখা করেন তাঁর ছোট ভাই সৈয়দ নজরুল ইসলাম। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
এরপর ২৫ ডিসেম্বর ফেনী-২ আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রচারে পুলিশ কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন অংশ নেন বলে অভিযোগ ওঠে। তিনি তখন ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরে উপকমিশনার পদে ছিলেন। পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান ২৩ ডিসেম্বর ফরিদপুর-২ আসনের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন—এই দুই কর্তৃপক্ষের যে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে এখন জবাবদিহিতার খুবই অভাব। এ জন্য আশঙ্কা করি, বিধি অনুযায়ী যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেটি নেওয়া হবে না।’
prothom alo