কোনো রকম ভনিতা না করেই আসল কথাটি বলে ফেলি। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মূলে আওয়ামী লীগের দিল্লিপ্রীতি যে প্রধান কারণ, তা দেশের সব মানুষ বুঝে গেছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের বিশ্বাস-ভালোবাসার প্রতিদানে দিল্লি বাংলাদেশের সাথে যা করেছে তা প্রধানমন্ত্রীর সারা জীবনের অর্জনকে রীতিমতো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অধিকন্তু পরিস্থিতি এতটা সঙ্গিন হয়ে পড়েছে যে, পুরো দেশের অর্থনীতি ভারতের বিহার রাজ্যের চেয়েও খারাপের দিকে এগোচ্ছে এবং সামাজিক সংহতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অপশাসন আফ্রিকার যেকোনো অধঃপতিত রাষ্ট্রের পর্যায়ে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে দিল্লির বলয় থেকে বের হতে না পারলে পুরো দেশ-জাতি রসাতলের অতলান্তে চলে যাবে এবং সেই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই আজকের শিরোনাম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আলোচনার শুরুতেই চীনের সাথে বাংলার ঐতিহাসিক সম্পর্কের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান বর্ণনা করে নিই। ভারতবর্ষে যখন মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো তখন রাজধানী মগধে তিন জন মহামানবের নেতৃত্বে বাংলা অঞ্চল পৃথিবীর প্রধানতম শান্তিপূর্ণ, সুসভ্য ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য বলে অভিহিত হতো। মহামতি চন্দ্রগুপ্ত, তার পুত্র বিন্দুসার এবং বিন্দুসারের পুত্র অশোক দ্য গ্রেটের জমানায় বাংলার নাম ছিল তোশালী। উত্তর ভারতে যখন মৌর্য বংশ রাজত্ব করছিল তখন চীন দেশে কিন রাজবংশের শাসন চলছিল। ফলে চীনের রাষ্ট্রদূত, পর্যটক, ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকরা দলে দলে ভারতবর্ষ আসতেন। যেহেতু বাংলা ছিল পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাজ্য; এ কারণে সবাই বাংলায় আসতেন সবার আগে। বিশ্ববিখ্যাত চীনা পর্যটক ফা হিয়েন, আইচিংয়ের মতো ধর্মপ্রচারক এবং জুয়াংজাংয়ের মতো বৌদ্ধ ভিক্ষু বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
বাংলাদেশে যখন পাল বংশের রাজত্ব ছিল তখন ঢাকার বিক্রমপুরের কৃতী সন্তান বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করকে চীন সরকার তাদের ধর্মীয় শহর তিব্বতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ ধর্মের শীর্ষস্থানীয় ভিক্ষু ছিলেন এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রমশিলার অধ্যক্ষ ছিলেন; যার অবস্থান ছিল বিহার রাজ্যে। তিনি তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার জন্য পুরো এশিয়াতে মশহুর ছিলেন এবং বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর কাছে অতিশয় সম্মানিত ছিলেন। বাংলার শাসক ধর্মপালের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে চীনা সরকার তাদের দেশে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা বিস্তারের জন্য মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করকে রাজকীয় মেহমান হিসেবে তিব্বতে নিয়ে যায়। মৌর্য শাসনামল থেকে পাল বংশের রাজত্বকাল অবধি ব্যবসায়-বাণিজ্য ও ধর্মকর্মের বিষয়ে চীন-বাংলাদেশের যেমন ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, তদ্রুপ বাংলায় ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল চীনের মাধ্যমে। বিখ্যাত সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস আল জহুরী চীন দেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য এবং চীনের গুয়াংঝু শহরে এই মহান সাহাবির মাজার রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা: বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় এসেছিলেন এবং নিজ উদ্যোগে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা আবি ওয়াক্কাস মসজিদ নামে ইতিহাসে সমধিক পরিচিত।
আজ থেকে ২৩২৬ বছর আগে চীনের সাথে বাংলার যে সম্পর্ক হয়েছিল তা কালের বিবর্তনে দিনকে দিন বেড়েছে। ইতিহাসের পরিক্রমায় চীন এবং বাংলা উভয় দেশ নানারকম প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। কখনো কখনো যুদ্ধবিগ্রহ, অভ্যন্তরীণ বিবাদ, বিদেশীদের আক্রমণ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে উভয় দেশে মানবেতর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু কোনো দিন পারস্পরিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়নি। এমনকি পাকিস্তান জমানাতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন বাংলার রাজনীতির প্রবাদপুরুষে পরিণত হলেন, তখন চীন দেশের আদলে তিনি বাংলায় একটি রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন। মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দল ন্যাপকে (পিকিংপন্থী) কমিউনিস্ট বলা হতো। অন্য দিকে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ ছিল মার্কিনপন্থী। আর ভারত তখন সার্বিক বিবেচনায় পাকিস্তানের তুলনায় এতটা দুর্বল এবং দরিদ্র ছিল যে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৯৬৫ সাল অবধি বাংলার জমিনে কোনো তৎপরতা চালাবে, এমন সঙ্গতি দিল্লির ছিল না।
বাংলার মানুষের রক্ত-মাংস ও হাড্ডির মধ্যে যেমন ভারতের প্রতি ঐতিহাসিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং ঘৃণা রয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে ভালোবাসা, আকর্ষণ এবং বিশ্বাস রয়েছে চীনের প্রতি। কারণ ঐতিহাসিকভাবে চীন কোনোকালেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে নিজেদের চীনের বাইরে গিয়ে অন্য দেশের ওপর জুলুম নির্যাতন করেনি। অনেকে হয়তো চেঙ্গিস-হালাকু-কুবলাই খানদের চীনের শাসক ভেবে ভুল করেন। এদের সম্পর্কে চীনের নাগরিকদের মধ্যেই রয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তির মতো মঙ্গোলিয়ার যাযাবররা চীনের মূল ভূখণ্ডে শত শত বছর ধরে উৎপাত করেছে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্যই চীনের প্রথম সম্রাট শি হুয়ান টি সর্বপ্রথম চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু চেঙ্গিস খান যখন প্রথম বেইজিং (সাবেক পিকিং) অবরোধ করেন তখন কোনো প্রতিরক্ষা ব্যুহই কাজ করেনি। ফলে মোঙ্গলদের দ্বারা চীন জাতি শুধু ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
চীনের প্রতি বাংলার মানুষের আবেগ-অনুরাগের দ্বিতীয় কারণ হলো, দেশটি তাদের প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া বিবাদ করে না। সীমান্ত নিয়ে ভারতের সাথে বিভেদ সত্ত্বেও চীন ভারতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে। এমনকি সীমান্তে যুদ্ধকালীন সময়েও বেইজিং দিল্লিকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। চীনের ২২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার স্থলসীমনায় ভারত ছাড়াও প্রতিবেশী হিসেবে রয়েছে উত্তর কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস ও ভিয়েতনাম। এবার আপনারাই বলুন, দিল্লির অস্ত্রধারীরা বাংলার সীমান্তে যেভাবে ফেলানীর লাশ ফেলে কিংবা বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড সদস্যদের পাখির মতো গুলি করে মারে ওভাবে কি চীন তার প্রতিবেশীদের সীমান্তে এ যাবৎকাল কিছু করেছে?
বর্তমানকালে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বিশ্বের যেকোনো শক্তিশালী দেশকে তারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে এমন নজির পৃথিবীতে নেই। এমনকি তাদের নাকের ডগায় তাইওয়ানকে নিয়ে আমেরিকা যে খেলা খেলছে অথবা তিব্বতকে নিয়ে ভারত যে চাল চালছে তার দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য চীন তার সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করেনি; বরং পরম ধৈর্য নিয়ে পুরো পরিস্থিতি কূটনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ পরিমানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
চীনের যে গুণটি বাংলার মানুষকে বিমোহিত করে তা হলো- চীনের জবান অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা ও সুবিবেচনা। তারা যদি কারো পক্ষে দাঁড়ায়, তবে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা বন্ধুকে ফেলে চলে যায় না। বিপদে বন্ধুর পাশে হিমালয়ের মতো অটুট শক্তি নিয়ে দাঁড়ায় এবং নিজেদের রাজভাণ্ডার থেকে বন্ধুরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা তারা করে। পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-নেপাল যদি সময়মতো চীনের আর্থিক, কারিগরি ও রাজনৈতিক সহযোগিতা না পেত তবে এতদিনে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যেত। অন্য দিকে, চীন যদি মালদ্বীপের পাশে না দাঁড়াত, তবে মালদ্বীপ এত দিনে দ্বিতীয় সিকিমে পরিণত হতো। উত্তর কোরিয়ার সাথে না থাকলে রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব বিলীন হতো আর ইরানের পাশে না থাকলে রাষ্ট্রটির পরিণতি ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন-লিবিয়া ও লেবাননের মতো হতো।
শেখ হাসিনা সরকারের সাথে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বিশ্ব ব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিলো, তখন চীন যদি বন্ধুত্বের হাত না বাড়াত তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো না। একইভাবে বাংলাদেশের ল্যান্ডমার্ক প্রকল্পগুলোতে চীনা বিনিয়োগ ও কারিগরি সহযোগিতা বর্তমান সরকারের মুখ উজ্জ্বল করেছে। অন্যদিকে, তারা তিস্তা প্রকল্প এবং ফারাক্কার বিপরীতে পদ্মা বাঁধ প্রকল্প নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চাচ্ছে তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল খুলে পড়বে এবং বাংলার আর্থসামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।
আপনি যদি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত দেশের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখতে পাবেন, ভারতের মদদে কিভাবে বিএনপি-জামায়াত নির্মূলের উপর্যুপরি প্রকল্প চালু রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া, জনবিচ্ছিন্ন এবং গণরোষের উপলক্ষ বানানো কত্তোসব আয়োজন চলছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে মহাশূন্যতা সৃষ্টি করবে এবং আরেকটি ১/১১-এর পরিস্থিতি ডেকে আনবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং অতীতের সামরিক অভ্যুত্থানগুলো, বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে ততোই আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে চীনের উপযোগিতা এবং গ্রহণযোগ্যতা অপরিহার্য বলে মনে হবে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসটি বর্তমান সরকারের জন্য এসিড টেস্ট। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের কোনো ঝুঁকি নেই। তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে কোনো হুমকি-ধমকি নেই। আমেরিকা ইউরোপকে ভয় পাওয়ার মতো কোনো কারণও দেখা যাচ্ছে না। অথচ সরকারের সব শীর্ষকর্তারই মন খারাপ। কারণ রাষ্ট্রের অর্থভাণ্ডারে টান পড়েছে এবং অতীতে একই কারণে পৃথিবীর বহু প্রতাপশালী রাজবংশ, বহু ক্ষমতাধর স্বৈরশাসক কিংবা কমিউনিস্ট মতাদর্শের একনায়কের পতন হয়েছে। সেসব পতনের ক্ষণে বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকায় কোনো কোনো দেশে ২০-২৫ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ইরাক-লিবিয়া ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের মূল কারণ সেখানকার নেতৃত্বশূন্য রাজনীতি এবং তলাবিহীন অর্থনীতি। সুতরাং আমাদের অর্থনীতির ঝুড়িতে যে অসংখ্য ফুটো তৈরি হয়েছে তা সামাল দেয়ার জন্য দিল্লিকে বাদ দিয়ে চীনমুখী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
nayadiganta