চলমান মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়

ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত মুদ্রানীতি (জানুয়ারি-জুন ২০২৪) বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠক
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত মুদ্রানীতি (জানুয়ারি-জুন ২০২৪) বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকছবি প্রথম আলো

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মুদ্রানীতিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিনিময় হার এখনো স্থিতিশীল নয়। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে সুযোগ বাংলাদেশের সামনে ছিল, তা অনেকটা সীমিত হয়ে এসেছে। চলমান মুদ্রানীতি তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনপ্রণেতাদের দিক থেকেও শক্তিশালী উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
আজ বুধবার দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত মুদ্রানীতি (জানুয়ারি-জুন ২০২৪) বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে দেশে প্রবাসী আয় আসছে। এতে দেশের গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির প্রভাব যতটা তীব্র হওয়ার কথা ছিল, ততটা হচ্ছে না। তবে আমরা এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির হারের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাও হয়তো অর্জিত হবে না। আমাদের রপ্তানি যেভাবে বৃদ্ধির কথা ছিল, সেভাবে বাড়েনি। ফলে এটা বলা যায়, আমরা অর্থনীতিকে ঠিক যে ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, সেখানে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা খুব ভালো হয়নি। বিনিময় হার এখনো বাজারের ওপর ছাড়ার মতো অবস্থায় আছে, তা বলা যাবে না। অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে আমদানি স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৮ থেকে ২০ মাস আগেও আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি ছিল উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও পরিমিত মূল্যস্ফীতির মতো সূচক। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিতে মুদ্রার বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির হার ও  সুদের হার—এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে বাগে আনা সহজ ব্যাপার নয়। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় থাকে। তবে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এখানে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটা শক থেরাপি দেওয়া প্রয়োজন। শক থেরাপি দিলে রপ্তানি যেমন বাড়বে, তেমনি প্রবাসী আয়েও ইতিবাচক ধারা দেখা যাবে।

এদিকে এলডিসি উত্তরণের কথা বলে রপ্তানি থেকে প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু দেখা যাচ্ছে রপ্তানিকারকদের জন্য ডলারের এক দাম, আবার প্রবাসী আয় নিয়ে আসলে তাকে দেওয়া হচ্ছে আরেক দাম। এটা ইতিমধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে বলে মত দেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আরও বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে তদারকি বাড়াতে হবে। অতীতে দেখা গেছে, বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে মন্ত্রী পর্যায় থেকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করা হয়েছে। আবার এটাও হতে পারে, তাঁরা এগুলোর অংশ হিসেবে এটা করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে আগেও গেছে, কিন্তু বর্তমান সমস্যা অন্য প্রজন্মের সমস্যা। এটা ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে, সামগ্রিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্ব নীতির সমন্বয়ের জন্য রাজনৈতিক অর্থনীতি ঠিক করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে মুদ্রানীতি নিয়ে এত আলোচনা হতো না, এখন হয়। সংবাদমাধ্যমগুলোতে এটা নিয়ে কথা হয়, এটা ভালো। তবে বর্তমান মুদ্রানীতি নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি আগের মুদ্রানীতিতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটা বাস্তবায়ন হয়নি, সেটা নিয়েও আলোচনা করতে হবে। জাতীয় সংসদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সদস্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করেন না, মুদ্রানীতি কতটুকু বাস্তবায়ন হলো বা এনবিআর তার লক্ষ্য কেন পূরণে ব্যর্থ হলো। জাতীয় সংসদ আইন তৈরির জায়গা হলেও অর্থনীতি নিয়ে সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা আসছে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে এলেও উচ্চ বিনিময় হারের কারণে আমরা এই সুবিধা নিতে পারছি না বলে উল্লেখ করেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ঢাকার (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান। বলেন, অর্থের সরবরাহ কমানো হচ্ছে, কিন্তু ব্যয় কমছে না। ব্যয় বেড়েই চলেছে, তাহলে শিল্প খাত চলবে কীভাবে। জ্বালানি থেকে ভর্তুকি কমানো হবে বলে জানানো হচ্ছে, অথচ আমরা ভর্তুকিতে অভ্যস্ত। খেলাপি ঋণের কথা অনেকে বলেছেন, যদিও এটাই অনেক সমস্যার কারণ। এই সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই হচ্ছে না। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, ভোগ্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের শক্তিশালী অবস্থান। এটা ভাঙা না গেলে নিত্যপণ্যের দাম কমবে না। মুদ্রানীতিতে এখন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আগে নেওয়া হলে সমস্যা এত প্রকট হতো না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

এখন ব্যবসা করতে গেলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি লাগছে, তাতে ব্যবসায়ীদের চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই অভিযোগ করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল ডলারের প্রবাহ। ভালো প্রবাসী আয় আসছিল। কিন্তু এখন সেটা অনেক কমে এসেছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে বেশ টাকাও ছিল, এখন কমে গেছে—সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশ চাপে আছেন।

বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বাজারে চার ধরনের বিনিময় হার দেখা যাচ্ছে। যাঁরা দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছেন, তাঁদের কষ্ট করে ডলার কিনতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব ডলার ব্যাংকের বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে, যা বাবা-মায়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। জনশক্তি রপ্তানি ভালো হলেও সেভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিলেও খেলাপি ঋণ কমছে না। যেভাবেই হোক, এটা কমাতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংসারের জন্য যেসব উদ্যোগ চলমান, তা আরও জোরদার করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, সুশাসনের অভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ব্যবহার দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ৬-৯-এর মধ্যে আটকে থাকার মূল্যটা আমাদের বুঝতে হবে। সে জন্য রিজার্ভের ওপর বড় রকমের চাপ পড়েছে। আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উন্নত দেশের মতো পদক্ষেপ নিতে পারিনি, আবার উন্নয়নশীল দেশের মতোও পদক্ষেপ আসেনি। বাংলাদেশের হাতে সুযোগ থাকলেও আমরা তা নিতে পারিনি। ফলে ২০ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার হারাতে হয়েছে। এখানে ১ লাখ ডলারের ঋণপত্র খুলতে গেলে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে৷ এসব বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলছে না।

সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপাচ্ছে। তবে এভাবে টাকা ছাপিয়ে যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে সেটা খারাপ চোখে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি শাহাদাত হোসেন। বলেন, এই টাকা যদি অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয় তাহলে সমস্যা, অর্থনীতির জন্য তা অনেক বড় ক্ষতির কারণ।

টাকা ছাপানো সব সময় খারাপ বলে মনে করেন না আইসিএবির সাবেক সভাপতি জামালুদ্দিন আহমেদ। বলেন, কোনো ব্যাংককে ছাপিয়ে টাকা দেওয়া হবে এবং সেই টাকা পাচার করে দেওয়া হবে, এমন হলে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনুমোদিত মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান আছে ২৫০-এর মতো, কিন্তু বাজারে ব্যবসা করছে ৭০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান। পারিবারিক ব্যাংকে ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে অনেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে, যার কারণে জবাবদিহি ঠিকমতো হচ্ছে না।

ইংরেজি পত্রিকা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের উপসম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, বিনিময় হারের ওপর চাপ এখনো বিদ্যমান। আমরা যেহেতু আমদানিনির্ভর দেশ, সেহেতু শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমবে বলে মনে হয় না। শীতের ভরা মৌসুমে ৭০ টাকা কেজিতে সবজি কিনে খেতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো সবজি কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে। শক থেরাপি হয়তো কাজ করতে পারে, তবে এতে অনেক মানুষের অবস্থা শোচনীয় হওয়ার শঙ্কা আছে। এটা মাথায় নিয়েই পদক্ষেপ নিতে হবে। ডলারের সংকট আছে, কিন্তু একই সময়ে টাকার কেন সংকট হলো, তার ব্যাখ্যা নেই। কোনো গবেষণা হচ্ছে না, রোগ নির্ণয় করে পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক নীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইসিএবির সিইও শুভাশীষ বসু, সভাপতি ফোরকান উদ্দিন ও সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির।

সূত্র : প্রথম আলো