চরিত্রের সংজ্ঞা ও বাংলাদেশের রাজনীতি
খালেদ আসাদুল্লাহ
প্রকৌশলী
ব্রীসবেন, অস্ট্রেলিয়া
বাংলাদেশে গত চল্লিশ বছরে মূল্যবোধের প্রচুর অবক্ষয় হয়েছে। ঘুষ খায়নি অথবা ঘুষ দেয়নি এমন লোক কম আছে। লোকে বলে ঠগ বাচতে গাঁ উজাড় হবে। ছোটবেলা পড়েছিলাম, “ অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তাকে যেন তৃণ সম দহে”। চরিত্রবান বা চরিত্রবতীর সংজ্ঞায় আমাদের অবস্থা করুণ। ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, ‘গুরুজনকে সন্মান করিবে’ ইত্যাদি বোকার প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। হটাৎ করে গত কয়েকদিন ধরে “চরিত্র গেল, চরিত্র গেল “ বলে চিৎকার শুরু হয়েছে, কোর্ট কাচারিতে কয়েক’শ মামলাও ঠোকা হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা কি, কে এক মহিলা সাংবাদিক আশী বছরের এক বৃদ্ধ গুণীজনকে ইচ্ছাকৃত ভাবে জামায়েতের সাথে জড়িয়ে প্রশ্ন করাতে উনি ক্ষেপে গিয়ে মহিলাকে চরিত্রহীন বলেছেন। ইউটিউবের মাধ্যমে টকশোটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। । এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আসমা ভাট্টির প্রশ্নটা ছিল উদ্দেশ্যমূলক । কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মুহূর্তের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে অশোভন উক্তি করে বসেন। পরে ভুল বুঝে মেয়ের বয়সী আসমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন যদিও। কিন্তু আওয়ামী সরকার এই সুযোগ ছাড়েনি। শহরে বন্দরে লগী বৈঠার লাঠিয়ালরা মানহানির মামলা জুড়ে দিলে ঐক্য প্রক্রিয়ার বর্ষীয়ান নেতাকে শুধু কারাগারে পাঠাননি শেখ হাসিনা, এক সংবাদ সম্মেলনে একদা বিলেত ফেরত ব্যারিস্টারকে নিয়ে প্রচুর ঠাট্টা করে জনসমক্ষে হেয় করতেও দ্বিধা করেননি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলীয় সমর্থকদের উসকে দিয়ে আরও বলেছেন “ আপনারা শুধু মামলা ঠুকে দেন, বাকিটা আমি দেখব।“ নতুন কিছু নয়। ১৯৭২ সাল থেকেই আদালতের স্বাধীনতা নেই। ইতিহাস আর জনগণ তার সাক্ষী। শেখ হাসিনা সংবিধানকে তোয়াক্কা করেন না। একটি অপরাধের জন্য একটি মামলা হবে, এটা একটি বিধান। অবশ্য ওনার খুশী হোলে বিধানটি বদলে দিতে পারেন যখন তখন। যেমনটি করেছেন নির্দলীয় সরকার নিয়ে।
মইনুল হোসেনের বাবা তোফাজ্বল হোসেনকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পিতা বললে অত্যুক্তি হবে না। এহেন বাবার ছেলে ১৯৭১ সালে ইত্তেফাকের তৎকালীন সাংবাদিক সিরাজউদ্দীনকে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছেন বা সম্পৃক্ত ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এমনকি খন্দকার মোশতাকের সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। কতটুকু সত্য সেটা যাচাই করার দায়িত্ব চরিত্রবান নির্দলীয় সাংবাদিকদের। শেখ হাসিনা ভুলে যান যে ওনার মন্ত্রী সভার ও জোটের অনেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যায় উদ্বেলিত হয়ে মোশতাককে আলিঙ্গন করেছিল। মইনুল হোসেন আসমা ভাট্টীর চরিত্র হনন করেন নি। শব্দচয়নে ভুল ছিল, কোন অশোভন ইংগিত ছিল না। অন্যায় হয়েছে, মানহানির মামলা হয়েছে। এ ধরনের মামলা দুনিয়ার সব দেশে হয়। কিন্তু জামিন হয়। সংসদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অসভ্য ব্যাবহার, নোংরা কথাবার্তা ও একে অপরের চরিত্রহনন সর্বজনবিদিত। নারী পুরুষ সবার প্রতি শামীম ওসমানের জঘন্য আচরণ ইউ টিউবের পর্দায় বিদ্যমান। অস্ট্রেলিয়ায় পার্লামেন্ট ও সিনেটের সব বিতর্ক ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশে তথাকথিত গনতান্ত্রিক দেশ, ধরে নিব আমাদের দেশের সংসদেও হয়। পাকিস্তানি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ভারতে যান। কিন্তু যুদ্ধকালীন দশ মাস বেগম জিয়া ভারতে না গিয়ে দুই ছেলে নিয়ে ঢাকাতে কিভাবে ছিলেন, তা নিয়ে সমাজে নানারকম রসালো গুজব রটানো হয়েছিল। ৯০ সালের শেষের দিক। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া। সংসদে বিতর্ক চলার এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা পাকিস্তান আর্মীর সাথে খালেদা জিয়ার সম্পর্ক নিয়ে তাঁকে ‘নিশিপদ্ম’ আখ্যা দেন । তারাশংকরের এই বিখ্যাত উপন্যাসের নায়িকা একজন পতিতা। খালেদা জিয়া ও উপস্থিত বিএনপি সাংসদরা হয়ত বইটি পড়েন নি। পড়লে হয়ত তখনি হাতাহাতি কিলঘুষি শুরু হয়ে যেত। স্পিকারকে চেয়ার দিয়ে না মারলেও , হয়তবা দু’একটা পেপার ওয়েট ছোঁড়া হোতো। পরদিন সংবাদপত্রে মৃদু সমালোচনা হলেও মহিলা সমাজ প্রতিবাদ করেনি। সেই তুলনায় আসমা ভাট্টী ভাগ্যবতী। দুর্ভাগ্য মইনুল হোসেনের।
১৯৭২ সাল থেকে আমরা গনতন্রের নামে দেখেছি একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র ।দলীয় অধীনে নির্বাচনে কারচুপি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর কিছু বর্ষীয়ান নেতা চেষ্টা করছেন সুস্থ নির্বাচনের মাধ্যমে মুক্তি যুদ্ধের চেতনার গণতন্ত্র কায়েম করা যায় কিনা।। জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা । কঠিন ও দুরূহ কাজ, সন্দেহ নেই।। কিন্ত সম্ভব, যদি দুই বৃহৎ দল তাদের রাজনৈতিক চরিত্র বদলাতে রাজী হয়। ঘুষ, গুম আর খুনের চরিত্রবদলায়, হাজার হাজার কোটি টাকার লুটেরা চরিত্র বদলায়, ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার চরিত্র বদলায়। সম্ভব যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থকরা দেশের কথা ভেবে তাঁদের বিবেক ফিরে পায়। যদি নতুন প্রজন্ম শুধু নিরাপদ সড়ক নয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দূর্বৃত্তিয়ান ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
আশার কথা আওয়ামী লীগ সংলাপে রাজী হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার দাবী আর ৭০ সালের ছয় দফা দাবীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। নাটকের চরিত্র ঠিক আছে, শুধু অভিনেতা বদলেছে। বিকল্প ধারা, জাতীয় পার্টি ও বামপন্থীদের মূল দাবিতে ঐক্যফ্রন্টের মিল আছে। জাতির এই সন্ধিক্ষণে আসনের লোভে, গদির মোহে কোন প্রকার মীরজাফরি দেশবাসী ক্ষমা করবে না । সংলাপ যেন সংগ্রামে পরিণত না হয়।
১/১১/১৮