চক্ষু বন্ধ রাখলেই প্রলয় থামবে না

চক্ষু বন্ধ রাখলেই প্রলয় থামবে না – ফাইল ছবি

কলেজ জীবনের পরম শ্রদ্ধেয় এক শিক্ষকের কাছে প্রায় সময়ে যেতাম। চার্মি পারসোনালিটি বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই ছিলেন। তার সান্নিধ্যে নানা কারণে আমার মতো অনেকেই তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করত। তার পাণ্ডিত্য কখনই তাকে আমাদের কাছে দুর্বোধ্য করেনি বরং জ্ঞানের এক সৌন্দর্য তাকে ভদ্র বিনয়ী স্নেহপ্রবণ সদালাপী করে তুলেছিল। সেজন্যই তার প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা তো ছিলই, সেই সাথে সবারই তিনি ছিলেন সখা। সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, ইতিহাস নিয়ে তার জ্ঞানগর্ভ প্রাঞ্জল আলোচনায় আমরা মুগ্ধতায় তন্ময় হয়ে যেতাম। আর অবাক হতাম তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হওয়া সত্তে¡ও কখনো ভুলক্রমে আমাদের সাথে রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা করতেন না। জানি না, কেন করতেন না; এর কারণ বোধ হয়, রাজনীতি বহু ক্ষেত্রে বিতর্ক বিভক্তি আর অন্ধত্ব সৃষ্টি করে। তা ছাড়া রাজনীতি নিয়ে তার নিজস্ব মত থাকলেও কেউ তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, সেটা তিনি হয়তো চাইতেন না। তাই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা থেকে তিনি বিরত থাকতেন।

এসব অনেক দিন আগের কথা। আজ হঠাৎ করেই তার কথা স্মরণ করছি। চলমান পৃথিবীর নানা বিষয় নিয়ে এমন সব খবর পড়ছি, যা অত্যন্ত ভীতিকর, মানুষ তার আত্মবিলুপ্তির পথটি স্বয়ং রচনার কাজটি প্রায় শেষ করে এনেছে। আমাদের সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এক দিন আলাপকালে বলেছিলেন, আমি যদি আরো ১০-১৫ বছর পরে জন্মাতাম, তবে হয়তো জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন সব উদ্ভাবন দেখা ও জানার সুযোগ হতো।’ তার সে আশা যদি পূর্ণ হতো। তবে আজ অবধি তিনি বেঁচে থাকতেন কি না জানি না। বেঁচে থাকলে অবশ্য তার ধারণা অনুসারে বিশ্বের বহু বিচিত্র অগ্রগতি, উদ্ভাবন, আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে পারতেন। তার সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ হতে পারত। সেই সাথে এমন সম্ভাবনাও ছিল বিশ্ব নিয়ে তার প্রত্যাশা আর যে স্বপ্ন ছিল, পৃথিবীতে আজকে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে চলেছে। তাতে তার সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতো নিশ্চয়ই। মানুষ মানুষের জন্য বলা হয়, তা আর এখন নেই। বরং মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিকতাই এখন চলছে। অর্থাৎ মানুষ স্বয়ং মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার পথটি রচনার শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যৌবনের প্রারম্ভে একটি গান অনেকের কণ্ঠে গীত হতো। ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায় নাহি চায়।’ আজকের এই পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই গানটির যে আকুতি তা তো অর্থহীন হতে চলেছে। এই সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশ্বকে নিয়ে নানা দেশের অসংখ্য কবি গীতিকার সাহিত্যিক হাজারো ভাষায় কত অমর কাব্য সঙ্গীত আর সাহিত্য রচনা করেছেন। মানব গোষ্ঠীর কোটি কোটি সদস্য পৃথিবীতে দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার কত না বাসনা আকুতি পোষণ করেছে। পৃথিবীতে মানুষকে দীর্ঘজীবী আর রোগমুক্ত রাখতে কত গবেষণা আর ওষুধ তৈরি করা হয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আজ কি তার সব ‘গরল ভেল’ হতে চলেছে?

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে একখানা ছবি ছাপা হয়েছে, সেখানে দেখা যায়- এক দল শৃগাল প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে লোকালয়ে চলে এসেছে। সম্ভবত বনের পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতিক‚লতার কারণেই তারা বেরিয়ে এসেছে। আমার শিক্ষক তো এটাই জানতেন, পশুরা বনের সৌন্দর্য। আজকে এত যে বৈরী পরিবেশ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ভীতিকর যত দুঃসংবাদ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ যত চিত্র এসব তাকে বিষম মানসিক যাতনার মধ্যে ফেলত। তার পরে জন্মানোর সেই কল্পনা কী পরিণতি লাভ করত!

সৌন্দর্যে ভরা আমাদের পরম প্রিয় গ্রহটি ধীরে ধীরে বিলীন হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। স্রষ্টা বিশ্বকে যে রূপ সৌন্দর্য দিয়ে বিন্যস্ত করেছেন, বিপথগামী মানুষ স্বয়ং তাকে তছনছ করে দিচ্ছে। মানুষ তার হাতে যা অর্জন করে তার ফল তাকেই ভোগ করতেই হয়। সেই ফলই আজ বিশ্বকে বিপর্যয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘ সম্প্রতি মানবজাতির জন্য বিপর্যয়ের যে সর্বোচ্চ সতর্ক বার্তা দিয়েছে তা গোটা বিশ্বের সচেতন মানুষকে ভীত হকচকিত, হতবুদ্ধি ও সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। সে বার্তার সারমর্ম হচ্ছে, দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন ভারত ও জার্মানিতে চলতি মওসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার কবলে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। কিছু দিন আগে অস্ট্রেলিয়াতেও মারাত্মক দাবানলের সৃষ্টি হয়েছিল। বেলজিয়ামসহ কয়েকটি দেশ রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি দেখেছে। ব্রাজিল এবং মাদাগাস্কারসহ পুরো আফ্রিকা এখন খরায় বিপর্যস্ত।

যখন জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব, এমন সময় এসব দুর্যোগের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বের একদল বিজ্ঞানী। তারা বলেছেন, সম্প্রতি মানুষের যত অপকর্মে বিশ্বের জলবায়ু সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত হয়েছে। এর প্রভাব মানবজাতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর উষ্ণতা যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে চূড়ান্ত বিপদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে মানব সভ্যতা। যেসব বিজ্ঞানী এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি রচনা করেছেন, সেই বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিবেদনকে মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা বলে মনে করেন। বিরল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী গ্রহটিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমাতে হবে। তাতে এক দিন বিলম্ব করার সময় নেই। না হলে পৃথিবী নামক গ্রহটি তার সাত শত কোটির বেশি মানবসন্তান, হাজারো ধরনের প্রাণিকুল পাখ-পাখালি বন-বনানী জীববৈচিত্র্য নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। উষ্ণতা কমাতে না পারলে বিপন্ন হয়ে পড়বে সভ্যতা। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ১৯০১-১৯৭১ সালের তুলনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এর ফল হবে আরো মারাত্মক, যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ২০৪০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে বিজ্ঞানীরা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। তাদের ধারণা, ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরের পানি ৫ মিটারও বাড়তে পারে।

‘প্যারিস চুক্তি’তে বলা হয়েছে চলতি শতাব্দীতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হবে এবং ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে। কিন্তু নতুন প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে যেভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে শতাব্দী শেষে সব সূচক অতিক্রম করবে। কয়েক শ’ বিশেষজ্ঞের গবেষণা ও সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রায় ৮ বছর ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আইপিসিসি, যেখানে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বশেষ বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে ১৯৮৮ সাল থেকে।
বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবগুলো ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় দাবদাহে গত জুনে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ব্রাজিল এখন গত ৯১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখোমুখি। জাতিসঙ্ঘ থেকে বলা হয়েছে, এই গ্রহটিকে ধ্বংস করে দেয়ার আগে এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির মৃত্যু ঘণ্টা বাজানো উচিত। আমরা যদি সব শক্তি এক করতে পারি, তাহলে হয়তো জলবায়ু বিপর্যয় রোধে এগিয়ে যেতে পারব।

দ্য ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক প্রতিবেদনে একই কথা বলা হয়েছে, যা প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। কোভিডের প্রকোপ, নিত্যদিন ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, মহামারী-ভবিষ্যতে আর কী কী অপেক্ষা করছে মানুষের জন্য? এসব ভীতিকর অনুভূতিই এখন ঘুরছে মানুষের মনে। এমন বিপর্যয়ের সাথে কখনো মানুষকে মোকাবেলা করতে হয়নি। এখনো মনে আছে ২০১২ সালের শেষে মায়ান ক্যালেন্ডার কী বলেছিল? সে ক্যালেন্ডার বলেছিল ২০২০ সালেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। পৃথিবী ধ্বংস না হলেও প্রায় ২১ লাখ মানুষ কোভিডে মারা গেছে এবং আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১০ কোটি মানুষ। তবে এসব সংখ্যা হাল নাগাদ নয়। কোভিড পৃথিবী থেকে কবে বিদায় নেবে তা কেউ জানে না। কোভিড শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আর কত মানুষ আক্রান্ত হবে, মৃত্যুবরণ করতে পারে, তা-ও তো ভবিষ্যতের গর্ভে লুকানো রয়েছে যে বিষয় কেবল স্রষ্টাই জানেন।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে পৃথিবী কবে ধ্বংস হবে সেটা অবশ্যই নির্ধারণ করে রেখেছেন স্রষ্টা। এটা ঠিক, পৃথিবী এত পাপের বোঝা এখন আর সহ্য করতে পারছে না।

মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যেকোনো সময় পৃথিবী লক্ষ্য করে তিনটি বিশালাকৃতির গ্রহাণু ধেয়ে আসতে পারে। এই গ্রহাণুগুলোর কোনো একটি সাথে পৃথিবীর ধাক্কা লাগলেই মানব সভ্যতার বড়সড় ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রাচীন সভ্যতা, মধ্যযুগীয় সভ্যতা কোনো সভ্যতাই আজ আর নেই। আজকের সভ্যতাও তো সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। তাই ইতিবাচক কিছুই ভাবনায় আসছে না। সম্মুখে সব অন্ধকার ।

বিগত কয়েক বছর প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে ভূমিকম্প হচ্ছে। বলা হচ্ছে এমন ভূমিকম্পেই শেষ হয়ে যাবে পৃথিবী। সূর্যের গায়ে সৌর কলঙ্কের চিহ্ন ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। তাই এ রকম একটা পরিস্থিতি ঘটতেই পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শুধু তাই নয়, এর সাথে সূর্যের চুম্বকীয় ক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। ফলে মহাজাতিক রশ্মি অতিরিক্ত মাত্রায় সৌর জগতে প্রবেশ করছে যার কারণে ভয়ঙ্কর একটি ভূমিকম্প হলেও হতে পারে গোটা বিশ্ব জুড়েই। নানা স্থানে বরফ গলতে শুরু করেছে। গত কয়েক বছরে ভয়াবহ দূষণের কারণেই বরফ গলছে।
বিপদের এমন অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে আগামী ১ থেকে ১২ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তার আগে বিশ্বের আসন্ন বিপর্যয় বিপদ সম্পর্কে সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সে সম্মেলনে প্রতিবেদনগুলো উপস্থাপন করা হবে। বিশ্ববাসী সেই সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যিকার অর্থে সেই সম্মেলন থেকে পৃথিবী বিলুপ্ত রোধের বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক কার্যকর কোনো কর্মসূচিও পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয় কি না দেখার বিষয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী যে উন্নত রাষ্ট্রগুলো তারা সেখানে থাকবেন। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কলকারখানা থেকে প্রতিদিন যে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তাই এই গ্রহের উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ। এসব দেশ কয়লা জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। উন্নত দেশগুলো সব কিছু নিয়েই গবেষণা করে থাকে। তাই বিশ্বের বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসী সম্প্রতি কেবল জানতে পেরেছে; কিন্তু তা তারা অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু সব দায় তাদের ঘাড়ে পড়বে বলে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।

এ দিকে বিশ্বে যে দুই শতাধিক রাষ্ট্র রয়েছে, তাদের প্রায় কেউ-ই এই উষ্ণায়নের জন্য দায়ী নয়। তার পরও তাদের যদি কিছু করার থাকে তবে তাদের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা দরকার। সব চেয়ে বড় কথা, যারা বিশ্বের এই উষ্ণায়নের হোতা, তাদের পরিষ্কার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করতে হবে। শুধু বলার জন্য বলা নয় আর কপটতা নয়। এই বলার প্রতি বিশ্বস্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এ দিকে বিশ্বে যে প্রলয় ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে পৃথিবীর সাত শতাধিক কোটি মানুষ প্রকৃত অর্থে অন্ধকারে রয়েছে। এসব মানুষের কাছে এই বিপর্যয়ের বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে পরিবেশ ও আবহাওয়া জলবায়ু নিয়ে সবাই যাতে সতর্ক হয়। প্রতিটি ব্যক্তি যদি তার অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম অবদান রাখতে পারে তবে তা কম নয়। মনে রাখতে হবে ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল; গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’।

এ দিকে আরেক দুঃসংবাদ দিয়েছে ‘নাসা’। ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে নাসার বরাত দিয়ে তা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে সমুদ্র উপকূলবর্তী অন্তত ৩০টি দেশে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হবে যা মানুষের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। সে খবরে বলা হয়েছে, চাঁদই ভয়াবহ এই বিপদের কারণ হয়ে উঠতে চলেছে আর মাত্র অল্প ক’দশকের মধ্যে। পৃথিবীতে প্রদক্ষিণের সময় কক্ষপথে চাঁদের টলোমলো পথে হাঁটার জন্যই তা সঙ্ঘটিত হবে। চাঁদের সেই খেয়ালিপনাই ভয়ঙ্কর বন্যা ডেকে আনতে চলেছে তিনের দশকে। অর্থাৎ আর ১০ বছরের মধ্যেই। সমুদ্র ও মহানগরীগুলোর মধ্য দিয়ে বহমান নদ-নদীর পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে উঠে এসে ডেকে আনবে সেই ভয়াল বন্যা যা খুব ঘন ঘন হবে। পানির তলায় কয়েক মাস রেখে দেবে আমেরিকাসহ সমুদ্র উপক‚লবর্তী বহু দেশের বহু শহরকে।

নাসার গবেষণা প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ রয়েছে, কক্ষপথে একটু ঝুঁকে পড়ে চাঁদ “বিশ্বকে প্রদক্ষিণ করে আর নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই ঝুঁকে ‘থাকা অবস্থায় চাঁদ’ টলোমলো পায়ে হাঁটবে” বলেই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বকে প্রদক্ষিণের পথে সাড়ে ১৮ বছরের একটি চক্র রয়েছে তাদের, ওই সাড়ে ১৮ বছরের সময় চাঁদের জন্য সমুদ্র, মহাসাগরে ভাটার পরিমাণ ও প্রাবল্য বেশি হয় জোয়ারের চেয়ে। কিন্তু সেই অবস্থা বদলে যাবে এই শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পা দেয়ার পরপরই। প্রশ্ন উঠতে পারে, কক্ষ পথে প্রদক্ষিণের সময় এমন ঘটনা তো আগেও ঘটেছে। কিন্তু এবার কেন তা ভয়াবহ বন্যা ডেকে আনতে চলেছে? আমেরিকাসহ সমুদ্র উপক‚লবর্তী প্রায় সব দেশেই তা হবে যার মধ্যে পড়ে ভারতও, সুদীর্ঘ সমুদ্র উপক‚ল থাকার জন্য।

নাসার জনৈক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এ জন্য দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ও সমুদ্রের পানির স্তরের দ্রুত উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া যা গত ৩০০ বছরের রেকর্ড ইতোমধ্যে গড়ে ফেলেছে। উষ্ণায়ন এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্রের পানির স্তর আরো উঠে আসবে। সাথে যোগ হবে চাঁদের জন্য জোয়ারের পরিমাণ ও প্রাবল্য বৃদ্ধি। এ জন্য শহর ও অঞ্চল পানির তলায় থাকতে হবে বছরের একটা দীর্ঘ সময়। নাসা আরো জানিয়েছে, শুধু আমেরিকারই সমুদ্র উপকূলবর্তী শহরগুলোতে তিন দশকে ভয়াবহ বন্যার পরিমাণ অন্তত তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাবে। সেটা বছরজুড়ে হবে না, হবে বছরের কয়েকটা মাস। তার জন্য মানুষের স্বাভাবিক জীবন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বহু আগে থেকে আমরা শুনে আসছি, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটা বিরাট এলাকা সমুদ্রের পানির নিচে চলে যাবে যার কিছু আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সর্বশেষ পরিস্থিতির যেসব তথ্য গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে সে বিষয়ে আমরা দেশের কর্তৃপক্ষের কোনো নড়াচাড়া আগেও দেখা যায়নি এখনো লক্ষ করছি না। আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছি, সেখানে এসব নিয়ে কোনো ভাবনা রয়েছে কি না। না, তেমন কিছু সেখানে দেখা যায়নি। অথচ তাদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায়, তাদের মূল কাজ হচ্ছে পরিবেশ ও বনসংক্রান্ত সরকারের কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা, প্রচারণা, সমন্বয় এবং দেখভাল করা। বাংলাদেশের পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের দেখাশোনা করা হয়েছে। জাতীয় সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভ‚মি, বন বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ বস্তুত রাষ্ট্রের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই সংবিধানে উল্লিখিত বিষয় নিয়ে কাজ করবেন। কিন্তু আমরা জানিও না, দেখিও না মন্ত্রণালয়ের কোনো তৎপরতা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ সংক্রান্ত বিপর্যয় ভয়াবহ। সে সম্পর্কে বলতে গেলে স্বতন্ত্র নিবন্ধ রচনা করেও তার সব বিপর্যয় বলে শেষ করা যাবে না। দেশ এখন যে কত বিপদের মুখোমুখি। সব দেখে মনে হয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় চোখ বুজে আছেন। জানি না পরিবেশ মন্ত্রণালয় তাদের হাতগুটিয়ে বসে থাকার কী জবাব জাতিকে দেবেন?

মাত্র সাম্প্রতিককালে মানুষ জানতে পেরেছে জলবায়ুসংক্রান্ত যত দুঃসংবাদ। যা কয়েকটি উন্নত দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল জানেন, বিশ্বকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করার সব আয়োজন শেষ করে রেখেছে পৃথিবীর কয়েকটি মাত্র পরাশক্তি। রাজনৈতিক স্বার্থ, বিশ্বে কর্তৃত্ব করার জন্য অস্ত্র প্রতিযোগিতার জের হিসেবে তাদের হাতে রয়েছে হাজার হাজার পারমাণবিক বোমা যার মাত্র কয়েকটি বিশ্বকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে দিতে পারে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বর্তমানে ৯টি দেশের কাছে রয়েছে পারমাণবিক বোমা। ২০১৭ সালের হিসাব অনুসারে, রাশিয়ার হাতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক বোমা। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে রাশিয়ার কাছে এখন এ ধরনের বোমার সংখ্যা সাত হাজার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে এবং একমাত্র দেশ যারা এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করেছে। দেশটির হাতে এখন ৬,৮০০ পারমাণবিক বোমা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ফ্রান্সের হাতে ৩০০টির মতো বোমা রয়েছে। গণচীনের হাতে ২০১৭ সালের হিসাব মতে ২৭০টি পারমাণবিক বোমা আছে। তবে দ্রæত তারা সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। যুক্তরাজ্যের হাতে ২১৫ পারমাণবিক বোমা রয়েছে।
পাকিস্তানের কাছে ১৩০টির মতো বোমা থাকার কথা। ভারতের কাছে আনবিক বোমার মজুদ ১২০ থেকে ১৩০টির মতো। ইসরাইল কখনো নিজের দেশের পরমাণু কর্মসূচির তেমন কিছু প্রকাশ করে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের কাছে ৮০টি বোমা রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার কাছে ১০ থেকে ২০টির মতো পারমাণবিক বোমা আছে বলে ধারণা। বৃহৎ পরাশক্তিগুলো তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য বছর বছর হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে। অথচ বিশ্বের দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জন্য তারা তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করে না। তাদের বিবেক আসলে কেবল অস্ত্র প্রতিযোগিতা করে না; তাদের বিবেক আসলে অস্ত্র প্রতিযোগিতার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।
[email protected]