ঘোষণার ৩-৪গুণ বেশি রপ্তানি, টাকা আসে কম

রপ্তানির ঘোষণা দেয়া হয়েছে প্রায় দুই লাখ রেডিমেড গার্মেন্ট পণ্য। কায়িক পরীক্ষায় পাওয়া গেল প্রায় তিন লাখ পণ্য। জালিয়াতি এখানে শেষ নয়। প্রতি কেজি পণ্যের মূল্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৫ থেকে এক দশমিক ১৭ ডলার। একটি, দুটি নয়Ñ৩৭টি চালানে অতি নিন্মমূল্য বা নামমাত্র মূল্য ঘোষণা দিয়ে টি-শার্ট, সুইপ শার্ট, প্যান্ট,  ট্রাউজার, ক্যাপ প্রভৃতি রপ্তানির চেষ্টা করেছে একটি বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। শুধু এই প্রতিষ্ঠান নয়, বেশিরভাগ ‘বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক’ প্রতিষ্ঠানের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাত্র এক সপ্তাহে একটি বেসরকারি ডিপোয় রেডিমেড গার্মেন্টে ১১টি চালান যাচাই করেন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা, যাতে প্রতিটি চালানে ৯ থেকে ১৮৬ শতাংশ পর্যন্ত অনিয়ম পেয়েছেন।

অনিয়মের মধ্যে রয়েছেÑঘোষণার তিন-চারগুণ বেশি পণ্য, ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য, নামমাত্র মূল্য ঘোষণা, অ্যাসাইকুডায় শুল্কায়ন না করে ম্যানুয়ালি শুল্কায়ন করা প্রভৃতি। অথচ এসব চালান কাস্টমস কর্মকর্তারা পরীক্ষণ করে ‘ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্য’ পেয়েছেন মর্মে প্রতিবেদন দিয়েছেন। অনিয়মের সঙ্গে রপ্তানিকারক, কাস্টমস কর্মকর্তা ও ডিপো কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকরা ঘোষণার তিন-চারগুণ বেশি পণ্য রপ্তানি করছেন। অথচ রপ্তানির এই টাকা দেশে আসে না। তাদের রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার রোধ করতে হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এনবিআর সূত্রমতে, রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ রপ্তানিতে জালিয়াতি করছে। পণ্য রপ্তানিতে কখনও কম, কখনও বেশি ঘোষণা দিচ্ছে। আবার কখনও অতি নি¤œমূল্য ঘোষণা দিয়ে পণ্য রপ্তানি করছে। কখনও এক পণ্য ঘোষণা দিয়ে আরেক পণ্য রপ্তানি করছে। এর মাধ্যমে একদিকে রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে, অন্যদিকে রপ্তানির টাকা দেশে আসছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে অহরহ এসব ঘটনা ঘটছে। কখনও কাস্টম হাউস আবার কখনও কাস্টমস গোয়েন্দা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পণ্য আটক, মামলা ও জরিমানা করছে। কিন্তু এসব বাণিজ্যিক আমদানিকারক যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তবে রপ্তানির ক্ষেত্রে জালিয়াতিতে কাস্টম হাউসের গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

একাধিক সূত্রমতে, রপ্তানির ক্ষেত্রে কাস্টমসের তদারকি নেই বললেই চলে। প্রায় ক্ষেত্রেই রপ্তানির পণ্য চালান অ্যাসাইকুডায় শুল্কায়ন না করে ম্যানুয়ালি শুল্কায়ন করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা যেসব রপ্তানি পণ্য চালান শুল্কায়ন করে সঠিক পেয়েছেন, সে চালান কাস্টমস গোয়েন্দা শুল্কায়ন করার পর জালিয়াতির তথ্য পেয়েছেন, এমন নজিরও রয়েছে।

সূত্রমতে, কাস্টমস গোয়েন্দা মাত্র এক সপ্তাহে ১১টি রপ্তানি চালান যাচাই করে, সবকটিতে অনিয়ম পেয়েছে। এসব চালানে অস্বাভাবিক পরিমাণে মিথ্যা ঘোষণাসহ অতিরিক্ত ‘রেডিমেড গার্মেন্ট’ পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্থপাচারের  বিষয়টি উদ্ঘাটন করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। কাস্টমস গোয়েন্দা এসব চালান পরীক্ষণের সময় কাস্টম হাউসের প্রতিনিধি, একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ইহছাক ব্রাদার্স নামে বেসরকারি ডিপোয় থাকা বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকদের এসব চালান ‘ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে’Ñউল্লেখ করে কাস্টমস কর্মকর্তারা পরীক্ষণ করে ছেড়ে দিয়েছে। এসব রপ্তানিকারক রপ্তানির আড়ালে প্রচুর অর্থপাচার করেছে। এছাড়া এসব চালানের মাধ্যমে অর্থপাচারের চেষ্টা করেছেন। কাস্টমস গোয়েন্দা সেই ১১টি চালানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনসহ কাস্টম হাউসকে চিঠি দিয়েছে। ‘রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার রোধে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’ করতে অনুরোধ জানিয়ে ১৭ অক্টোবর চিঠি দেয়া হয়।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই ১১টি চালানে ঘোষণাবহির্ভূত বা ঘোষণা অতিরিক্ত প্রায় ৯ থেকে ১৮৬ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য পাওয়া গেছে। সি নাম্বার অনুযায়ী, ৫ অক্টোবরের একটি চালানে ৫৩ হাজার ৪০০টি রেডিমেট গার্মেন্ট পণ্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পরীক্ষণে ঘোষণার অতিরিক্ত ৯৯ হাজার ৩০৮টি পণ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ঘোষণার তুলনায় এই চালানে ১৮৬ শতাংশ বেশি পণ্য পাওয়া গেছে। অথচ কাস্টমস এই চালান পরীক্ষণ করে ‘ঘোষণার সঙ্গে সামসঞ্জ রয়েছে’ বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছে। একইভাবে ২৪ সেপ্টেম্বরের একটি চালানে ৫৩ হাজার ৭৩৫টির স্থলে ৮৩ হাজার ২৫৯টি অতিরিক্ত পাওয়া গেছে। এই চালানে অতিরিক্ত পাওয়া পণ্যের পরিমাণ ১৮১ শতাংশ। ৫ অক্টোবরের একটি চালানে ৫৩ হাজার ৭৩৫টি পণ্যের বিপরীতে অতিরিক্ত পাওয়া গেছে ৮৩ হাজার ২৫৯টি পণ্য, যা ঘোষণার অতিরিক্ত প্রায় ১৫৫ শতাংশ। ২৫ সেপ্টেম্বরে একটি রপ্তানিকারকের তিনটি চালানে ৯১ হাজার ৯৩১টি ঘোষণা অতিরিক্ত পণ্য পাওয়া গেছে, যা ঘোষণার চেয়ে ৭০, ৫৮ ও ৫১ শতাংশ বেশি। ৫ অক্টোবরের অপর এক রপ্তানিকারকের দুটি চালানে ৫৮ হাজার ৮১৮টি অতিরিক্ত পাওয়া গেছে, যা ৩৯ ও ৩৪ শতাংশ বেশি। ২৫ সেপ্টেম্বরের একটি চালানে ঘোষণার চেয়ে ১৪ হাজার ৮৭৪টি বেশি পাওয়া গেছে, যা ঘোষণার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। ২২ সেপ্টেম্বরের একটি চালানে ঘোষণার চেয়ে ছয় হাজার ১৩৯টি বেশি পাওয়া গেছে, যা ঘোষণার ১০ শতাংশ বেশি। ৫ অক্টোবরের একটি চালানে ছয় হাজার ১৩৭টি বেশি, যা ঘোষণার চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি।

১১টি চালান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পরীক্ষিত সব রপ্তানি চালানেই অস্বাভাবিক মিথ্যা ঘোষণা পাওয়া গেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই পণ্য চালান ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’-এ শুল্কায়ন না করে ম্যানুয়ালি শুল্কায়ন করে রপ্তানি অনুমতি দেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে অর্থপাচারের অপচেষ্টার বিষয়টি সুষ্পষ্ট। এতে সব ঘটনার সঙ্গে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ছাড়াও শুল্কায়নকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি কাস্টমসসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিদের নজরে এসেছে। এছাড়া ডিপো কর্তৃপক্ষের অ্যাসাইকুডা পর্যবেক্ষণের সুযোগ না থাকায় বিল অব এক্সপোর্টের হার্ড কপির বিপরীতে পণ্য চালান রপ্তানির উদ্দেশ্যে ছাড় প্রদান করে থাকে, যার মাধ্যমে কৌশলে পণ্য জাহাজীকরণের পর শুল্কায়ন কার্যক্রম অ্যাসাইকুডাতে সম্পন্ন করা হয়। রপ্তানি চালান পরীক্ষণ বা শুল্কায়নসহ অন্য সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে এ-জাতীয় ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না বলে কাস্টমস গোয়েন্দা মনে করে।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকদের রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে কাস্টম হাউসকে দেয়া চিঠিতে আটটি সুপারিশ করে কাস্টমস গোয়েন্দা। যার মধ্যে রয়েছেÑম্যানুয়ালি পণ্য চালান শুল্কায়ন দ্রুত বন্ধ করা, বিশেষ করে বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ চালানের ক্ষেত্রে; শুল্কায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজন; জড়িত আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শুল্কায়ন ও পরীক্ষণকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; ঝুঁকিপূর্ণ বা অস্তিত্বহীন রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের পণ্য চালান নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ; ডিপো কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের অ্যাসাইকুডা পর্যবেক্ষণের জন্য আইডি, পাসওয়ার্ড সরবরাহকরণ; সব রপ্তানি চালান পাঁচ বা দুই শতাংশ পরীক্ষণ না করে ঝুঁকিপূর্ণ চালান চিহ্নিত করে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকের পণ্য চালান ১০০ শতাংশ পরীক্ষণ; বন্দরের ন্যায় সব ডিপো গেটে নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়ন করা।

অন্যদিকে কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বাণিজ্যিক আমদানিকারকের চালান জব্দ করেছেন। এসব আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অতি নি¤œমূল্য দেখিয়ে রেডিমেড গার্মেন্ট রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি করা চালানগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে কাস্টমস গোয়েন্দা। একইসঙ্গে ঢাকা কাস্টম হাউস ও আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস দিয়ে রপ্তানি করা চালানের মাধ্যমে অর্থপাচারের তদন্ত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

কাস্টমস গোয়েন্দার তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কখনও অতি নি¤œমূল্য, কখনও ঘোষণার অতিরিক্ত, কখনও ঘোষণাবহির্ভূতভাবে রপ্তানি করা বেশ কিছু বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের অনুসন্ধান করছে কাস্টমস গোয়েন্দা। রেডিমেড গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার করা এসব রপ্তানিকারক শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নয়, ঢাকা কাস্টম হাউস ও আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস দিয়ে একই কায়দায় বিপুল পরিমাণ রেডিমেড গার্মেন্ট রপ্তানি করেছে। ঢাকা কাস্টমস ও আইসিডি কমলাপুর দিয়ে রপ্তানি করা এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। তালিকায় দেখা গেছে, ৯টি প্রতিষ্ঠান ঢাকা কাস্টম হাউস ও আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস দিয়ে এক হাজার ৭৩৬টি রেডিমেট গার্মেন্ট পণ্যের চালান রপ্তানি করেছে। রপ্তানি করা এসব চালানের বেশিরভাগ শুল্কায়ন করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑবিএফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, টোটাল কোয়ালিটি কোম্পানি, ফাস্ট এক্সপোর্ট (বিডি) লিমিটেড, সায়েম ফ্যাশন, খাজা ট্রেডার্স, বেলা ফ্যাশন চৌধুরী ট্রেড ইন্টান্যাশনাল, তাহসিন ইন্টারন্যাশনাল ও টপ মার্ক ইন্টান্যাশনাল।

এনবিআর সূত্রমতে, রেডিমেড গার্মেন্ট পণ্য তৈরিতে ব্যবহƒত কাঁচামাল বা কাপড় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকরা কাপড় আমদানি করে না। কিন্তু এসব কাপড় কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড় খোলাবাজার থেকে ক্রয় করে এসব রপ্তানিকারক। শত শত কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকরা শূন্য ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় ভ্যাট অফিস তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এসব বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক আয়কর নথিতে শত শত কোটি টাকার রপ্তানির হিসাব দেয় না। স্থানীয় ভ্যাট ক্রয় চালান নিশ্চিত করলে এবং আয়কর অফিস রপ্তানির হিসাব নিলে বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকরা রাজস্ব ফাঁকি দিতে পারবেন না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকদের রপ্তানিতে জালিয়াতির বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত। কোন পণ্য কী পরিমাণ যাচ্ছে, ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কি না, কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল কিনেছেÑকাস্টমস এমন শক্ত অবস্থান নিলে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থপাচার কমে আসবে।