ঘুষের দাবীতে চোখ বেঁধে ক্রসফায়ারের হুমকি : ওসিসহ ১১ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা
চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের নাম্বার ওয়ান হাতিয়ার হচ্ছে কথিত ক্রসফায়ার বা এ্যানকাউন্টারে মানুষ হত্যা করা। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কথিত ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যায় উৎসাহিত করতে পুলিশ ও র্যাবের জন্য রয়েছে রাষ্ট্রীয় পদক। গত এক যুগে শত শত মানুষকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা ও গুম করা বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ঘুষের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি ফেনীর ছাগলনাইয়াতেও ঘুষের জন্য বেপরোয়া হয়ে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে সেখানকার পুলিশের বিরুদ্ধে। যাকে-তাকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছিলো অর্থ। এমনই এক ঘটনায় পুলিশের ১১ জন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছেন ভুক্তভোগী এক পিকআপ চালক।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ লাখ টাকার ঘুষ দাবিতে এক চালককে ইটখোলায় নিয়ে চোখ বেঁধে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ছাগলনাইয়ার সাবেক ওসি ও তার ‘ক্রসফায়ার বাহিনী’। তিনি ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় সেই ব্যক্তির পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যু হয়েছে ভেবে হাসপাতালে ফেলে আসে তারা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও শটগানের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত পা কেটে ফেলতে হয়েছে তার। এতেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর পর কারাগারেও পাঠিয়েছিলো সেই চালককে।
লোমহর্ষক সেই ঘটনায় ছাগলনাইয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এম মুর্শেদসহ ১১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া মো. গিয়াস উদ্দিন দুলাল নামের সেই ব্যক্তি।
মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) সকালে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসানের আদালতে মামলা করেন মো. গিয়াস উদ্দিন দুলাল। এতে ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১১ জন পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্য। বাকী দুইজন পুলিশের সোর্স।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বাদি গিয়াস উদ্দিন দুলাল একজন পিকআপ চালক। তিনি গত বছরের ১৭ জানুয়ারি দুপুরে ফেনী সদরের কাজীরবাগে মাটি বহন করার সময় মাদক মামলার ভয় দেখিয়ে থানার আবুল হাসেম ও আবুল খায়ের নামে দুই সোর্সসহ পুলিশ সদস্যরা এসে তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বিকালে তারা কাজীরবাগ থেকে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর এলাকায় ব্রাদার্স ব্রিকফিল্ডে নিয়ে যায়।
সেখানে ওসি মোর্শেদ এসে চোখ বেঁধে ফের ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ক্রসফায়ারের হুমকি দেন। পরে খবর পেয়ে মা ও বোন ১ লাখ দেবার কথা বললেও ওসি রাজী না হয়ে ফের চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে একই উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের বল্লভপুর গ্রামের রাস্তায় মাথায় একটি নির্জন স্থানে নিয়ে ওসি মোর্শেদের নির্দেশে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়।
একপর্যায় ওসি মোর্শেদ ঘটনাস্থলে সাথে থাকা সুকান্ত বড়ুয়া নামে এক পুলিশ সদস্যের শটগান নিয়ে দুলালের ডান পায়ে ৩ রাউন্ড গুলি করেন। এরপর তারা এলোপাথাড়ি লাথি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। অজ্ঞান হয়ে পড়লে মৃত্যু হয়েছে ভেবে তারা ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থা আশংকাজনক দেখে চিকিৎসক চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠান। সেখানে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপাচার করে ডান পা কেটে বাদ দেয়। ৭ দিন পুলিশের হেফাজতে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফের তার বিরুদ্ধে ১৪শ পিস ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করে কারাগারে পাঠান তারা।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, পঙ্গু হবার পর থেকে তিনি অসুস্থ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই মামলা দায়েরে দেরি হয়েছে।
ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন তিনি।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু জানান, আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশের হাতিয়ার ‘ক্রসফায়ার’
ক্রসফায়ারের বর্ণনা এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অজানা নয়। আওয়ামী লীগের চলমান দু:শাসনে রাজনৈতিক বা ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষকে দমন করতে র্যাব বা পুলিশকে ব্যবহার করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয়েছে শত শত মানুষকে। এসব কাজের পুরস্কার হিসেবে র্যাব বা পুলিশের শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিদের নিজ হাতে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পিপিএম এবং রাষ্ট্রপতি পদক বিপিএম দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সবশেষ টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমারকে ক্রসফায়ারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় একাধিক খুনের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে হত্যা করে তিনি আর পার পান নি। ধরা পড়ে তিনি এখন কারাগারে।
অপকর্মের শেষ নেই:
ইয়াবা ও অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে গ্রেপ্তারের পর ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগে চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার সাবেক ওসি হিমাংশু কুমার দাশসহ ৮ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই মামলায় তাদের সঙ্গে আরো ৩ জনসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার বাদী সমরকৃষ্ণ চৌধুরীর দেওয়া তথ্যনুযায়ী অভিযুক্তরা হলেন, বোয়ালখালী থানার সাবেক ওসি হিমাংশু কুমার দাশ, পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুব আলম আখন্দ, বোয়ালখালী থানার সাবেক এসআই মো. আতিক উল্লাহ, এসআই আবু বক্কর সিদ্দিকী, এসআই রিপন চাকমা, এসআই আরিফুর রহমান, এসআই দেলোয়ার হোসেন ও এএসআই আলাউদ্দিন।
ক্রসফায়ার এখন পুলিশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে চলতি বছরের আগস্ট মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক ব্যক্তি।
গত ১২ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আখাউড়া) আদালতে মামলাটি দায়ের করেন আখাউড়া উপজেলার পৌর শহরের মসজিদ পাড়ার বাসিন্দা হারুন মিয়া। অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য আখাউড়া থানায় কর্মরত।
একইভাবে ঢাকার কোতোয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমানসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মামলা হয়েছে ১৩ আগস্ট৷ মামলার বাদী কেরানীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সোহেল মীরের অভিযোগ, গত দুই আগস্ট ঢাকার ওয়াইজ ঘাট থেকে তাকে আটক করা হয়৷ এরপর তার পকেটে থাকা দুই হাজার ৯০০ টাকা নিয়ে নেয় পুলিশ সদস্যরা৷ আরো টাকা দিতে না পারায় তাকে ইয়াবা মামলা দেয়ার কথা বলে কোতয়ালি থানায় নিয়ে যায়৷ থানায় নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে৷ শেষ পর্যন্ত পুলিশ দেড় লাখ টাকা নিয়ে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই দিয়ে কোর্টে চালান করে বলে অভিযোগ তার৷
রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধেও ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে ১২ আগস্ট ঢাকার আদালতে মামলা করেছেন গোলাম মোস্তফা নামে এক ব্যবসায়ী৷ আদালত অভিযোগটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে৷
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, ক্রসফায়ার, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে র্যাবের শীর্ষ কমান্ডারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে সিনিয়র ১০ মার্কিন সিনেটর যে আবেদন করেছেন, একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা পুলিশের ‘’ক্রসফায়ার’ এ যুক্ত সদস্যদের ওপরও করা উচিত।
তারা বলছেন, এসব অপকর্মে র্যাবের চেয়ে কোনো অংশেই বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তারা পিছিয়ে নেই। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই ক্রসফায়ারের নামে বছরের পর বছর হত্যাযজ্ঞ, ঘুষগ্রহন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হচ্ছে। সুতরাং একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।