ঘুষের জন্য উন্মাদনা

  • গোলাম মাওলা রনি
  •  ২১ জুন ২০২৪, ০৬:১৭
ঘুষের জন্য উন্মাদনা – নয়া দিগন্ত

বড় অঙ্কের ঘুষ আদায়ের জন্য হাল আমলে কী ধরনের উন্মাদনা চলছে তা নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে উন্মাদ নিয়ে কিছু বলে নিই। প্রাণী মাত্রেরই স্বাভাবিক বুদ্ধি রয়েছে। রয়েছে স্বাভাবিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য। মানুষ, বাঘ, সিংহ, শকুন, শুয়োর থেকে শুরু করে নর্দমার কীটেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং সহজাত বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। বুদ্ধির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যখন কোনো প্রাণীর মধ্যে অস্বাভাবিক অথচ অহিংস আচরণ দেখা দেয় তখন সেটাকে বলা হয় পাগলামো। অন্য দিকে পাগলামো যখন নির্মম, নিষ্ঠুর, সহিংস এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে তখন সেটাকে বলা হয় উন্মাদনা। আর যে প্রাণী উন্মাদনা শুরু করে আমরা সেটিকে লিঙ্গ ভেদে উন্মাদ না উন্মাদিনী বলে থাকি।

বাংলাদেশের ঘুষের রাজ্যে কী পরিমাণ উন্মাদনা শুরু হয়েছে তা নিয়ে আজকের নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে ঘুষ নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। আলোচনার শুরুতেই বলে নেয়া আবশ্যক যে, আল্লাহর তামাম মাখলুকাতের মধ্যে একমাত্র মনুষ্য প্রজাতির একটি অংশ ঘুষ নেয়, ঘুষ খায়, ঘুষ বাণিজ্য করে এবং ঘুষের সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। প্রকৃতির নিকৃষ্ট প্রাণী যেমন, বনের দাঁতাল শুয়োর, ভাল্লুক, হায়েনা প্রভৃতি প্রাণী ঘুষ খাওয়া তো দূরের কথা ঘুষ কী তা কখনো জানে না। মানুষ কোটি কোটি বছর চেষ্টা করেও ভয়ঙ্কর জন্তু জানোয়ারকে ঘুষ দিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করতে পারেনি।

জন্তু জানোয়ারের মতো অশরীরী আত্মা জিন-ভূত-প্রেত, শয়তান ঘুষ খায় না। পাখিদের মধ্যে ঘুষের প্রচলন নেই। বিষধর সাপ, সাগরের হাঙ্গর, তিমি প্রভৃতি ভয়ঙ্কর প্রাণী ঘুষ খায় না। শকুন-কাক-নেড়ি কুত্তার মতো প্রাণী যারা পচা মাংস, মৃত প্রাণীর মাংস এবং আবর্জনা খেয়ে জীবন ধারণ করে তারাও ঘুষ নামক শব্দটি আজ পর্যন্ত শোনেনি। সুতরাং সব প্রাণীকে পেছনে ফেলে মানুষ যে কারণে ঘুষ খায় তা খুঁজে বের করার জন্য মানবজাতির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে বহু দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গবেষক গলদঘর্ম পরিশ্রম করেছেন। ফলে ঘুষের কার্যকারণ কমবেশি সবাই আমরা জানি। তবুও জানা বিষয়গুলো আরেকটু ঝালাই করে নিই।

ঘুষখোরের যে কয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার মধ্যে প্রথমটি হলো সীমাহীন লোভ এবং লালসা। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো তার লোভ-লালসা চরিতার্থ করার জন্য যে পরিশ্রম করা দরকার তা সে কোনো মতেই করতে চায় না। তৃতীয়ত, ঘুষখোরের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা, অভাব বোধ, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনা এবং পরবর্তীতে সেগুলো হাসিলের লিপ্সা তাকে সর্বদা অস্থির করে তোলে। ঘুষখোরের পারিবারিক জীবন সাধারণত বিশৃঙ্খল, উচ্ছৃঙ্খল এবং অশান্তিময় হয়ে থাকে। এরা খুবই নীচু প্রকৃতির এবং নীচু বংশজাত হওয়ার কারণে ঘুষ খেয়ে দ্রুত ধনী হওয়ার কামনা এবং ধনী হয়ে উঁচুতলায় পৌঁছার কামনা দ্বারা তাড়িত হয়।
ঘুষ খেতে খেতে একটা সময় ঘুষখোরের মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়ে যায়। ঘুষের টাকার তাড়নায় তার মধ্যে এক ধরনের নেশা পয়দা হয়ে যায়। কোনো মাদক গ্রহণ করলে মানুষ যেমন লাজলজ্জা, হায়া-বিবেক ইত্যাদি হারিয়ে মাতলামি করতে থাকে তদ্রƒপ ঘুষখোরও ঘুষের নেশায় নানারকম অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। পৃথিবীর যেকোনো মাদকের চেয়ে ঘুষের নেশার প্রতিক্রিয়া বেশি হয়ে থাকে। ফলে যেকোনো মদ বা মদজাতীয় পানীয় অথবা হেরোইন-মরফিন-গাঁজা-আইস ইত্যাদি মারাত্মক নেশার সামগ্রী মানুষের আত্মা-বিবেক-বুদ্ধির সর্বনাশ করে তার চেয়েও বেশি সর্বনাশ করে ঘুষ।

মাদক বা নেশার সরবরাহ না পেলে মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখা দেয় তদ্রƒপ দীর্ঘদিন ঘুষ খেয়ে অভ্যস্ত ঘুষখোর যদি কোনো কারণে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ না পায় তবে ঘুষ আদায়ের জন্য সে উন্মাদনা শুরু করে। নেশাখোর নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য একদিকে যেমন পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র সবার সঙ্গে উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করে এবং প্রয়োজনে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, খুন-খারাবি করতে পারে তদ্রূপ ঘুষখোর তার কাঙ্ক্ষিত ঘুষের টাকার জন্য পারে না এহেন নীচু কর্ম দুনিয়াতে নেই।

আমরা এতক্ষণ যে আলোচনা করলাম সেখানে ঘুষখোরের মেজাজ মর্জি ইত্যাদির বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করেছি। এবার বলব ঘুষদাতাদের চরিত্র ও প্রবৃত্তি বিষয়ে। প্রথমত, ঘুষখোরদের মতো ঘুষদাতাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে রয়েছে বাহারি প্রকারভেদ। ঘুষদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু বংশটি ঘুষখোরদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তারা লোভ-লালসা-কামনা-বাসনায় ঘুষখোরদের চেয়েও জটিল প্রকৃতির। অন্যায়ভাবে কোনো বস্তু, পদ-পদবি, সহায় এবং সম্পত্তি লাভের জন্য ঘুষদাতারা হন্যে হয়ে ঘুষখোরদের খুঁজতে থাকে। এ ক্ষেত্রে ঘুষদাতাদের চরিত্র চলচ্চিত্রের ভিলেনদের মতো হয় কিংবা মারিও পুজোর বিখ্যাত উপন্যাস গডফাদারের প্রধান চরিত্রের মতো হয়।

ঘুষদাতারা অনেক সময় ঘুষখোরদেরকে ঘুষ নিতে বাধ্য করে। কেউ যদি তাদের ইচ্ছেমতো ঘুষ গ্রহণ না করে তবে ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। অথবা ঘুষের বিপরীতে যে লোভ-লালসার বস্তু থাকে তা যদি ঘুষদাতার ইচ্ছেমতো হস্তান্তর না করা হয় তবে জাহান্নাম কত প্রকার এবং কী কী হতে পারে তা হাতেকলমে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ঘুষদাতার সাঙ্গোপাঙ্গরা তাণ্ডব শুরু করে দেয়। এদের কবলে পড়ে অনেক ভালো মানুষ ঘুষখোরে পরিণত হয় এবং অনেক বেশি ভালো মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারায়।

ঘুষদাতাদের দ্বিতীয় স্তরটি সাধারণত নিরীহ প্রকৃতির লোভী হয়ে থাকে। এরা ঘুষখোরদের সঙ্গে দহরম মহরম বা হরিহর আত্মার সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো স্বার্থ ভাগাভাগি করে ঘুষের রাজ্যে একটি বিরাট বন্ধুত্বপূর্ণ সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলে। এরা নিজেদের কুকর্ম আরো জৌলুসপূর্ণ এবং নিরুপদ্রব করার জন্য নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলে। ঘুষদাতাদের তৃতীয় স্তরটি হলো নিরীহ আমজনতা। এদের ঘুষ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো লোভ-লালসা থাকে না। এরা জীবন-সম্পত্তি ও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। একটি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সব মানুষ যখন ঘুষ সিন্ডিকেটের নির্বিচার শিকারে পরিণত হয় তখন দেশ রসাতলে চলে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অন্য দিকে, রসাতলে যাওয়া দেশ কাল সমাজ যখন ঘুষখোররা ঘুষের দুর্ভিক্ষে পড়ে এবং ঘুষদাতারা ঘুষ প্রদানের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে তখন ঘুষখোরদের মধ্যে যে উন্মাদনা দেখা দেয় তার পরিণতি বলে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব।

ঘুষখোরদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরির কতগুলো পূর্বলক্ষণ রয়েছে। অর্থাৎ ঘুষখোররা যখন ঘুষের অভাবে পাগল হয়ে যায় এবং ঘুষ আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখায় তখন বেশির ভাগ ঘুষখোর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ক্ষুধার্ত পশু যেমন ক্ষুধার তাড়নায় স্বগোত্রীয় পশুদের হত্যা করে সেই পশুর মাংস ভক্ষণ করে ক্ষুণ্নিবৃত্তি করে তদ্রূপ ঘুষের দুর্ভিক্ষ শুরু হলে এক ঘুষখোর অন্য ঘুষখোরের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে অর্থ লাভের আদিম পদ্ধতি অনুসরণ করে। ফলে ঘুষখোরদের মধ্যে শুরু হয় ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ। প্রথমে মেঝো ঘুষখোর ছোট ঘুষখোরদের সম্পদ লুটপাট করতে থাকে। দ্বিতীয় স্তরে বড় বড় রাঘববোয়াল মাঝারি ঘুষখোরদের পেছনে লাগে এবং তাদের সর্বস্ব লুট করে থাকে। তৃতীয় স্তরে এসে যখন রাঘববোয়ালদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায় তখন ঘুষ সাম্রাজ্যের রথি মহারথিরা নজিরবিহীন সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যায়। একটি বিষাক্ত সাপ যেভাবে অপর একটি সাপকে গিলে ফেলে তদ্রূপ এক ঘুষ সম্রাট আরেক সম্রাটকে গিলে খায়। এর ফলে অনেকের হাড্ডি মাংসের খোঁজ পাওয়া যায় না। আবার অনেকে প্রাণভয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য