নিত্যদিনের খরচ চালাতেই খাবি খাচ্ছে মানুষ। মূল্যস্ফীতিতে জীবন জেরবার। এর মধ্যেই আসছে আরেক দুঃসংবাদ। বছর না ঘুরতেই গ্রাহক পর্যায়ে আবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। এবার বাড়তে পারে ৫ শতাংশ। এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার কারণেই এ দফায় বিদ্যুতের দর বাড়ছে। তবে আবাসিকে গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত থাকবে। পাশাপাশি কার্যকর হচ্ছে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দাম বাড়ানোর পদ্ধতি। এ কারণে নির্দিষ্ট সময় পরপর ডিজেল-পেট্রোলের দাম বাড়তে বা কমতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ আরও চাপে পড়বে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকিমুক্ত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। এ পটভূমিতেই বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সঙ্গে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় দাম সমন্বয় পদ্ধতি চালু হচ্ছে।
সরকার আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে পুরো বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পর্যালোচনা বলছে, ভর্তুকি তুলে দিলে বিদ্যুতের দাম ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে। সংস্থাটির সুপারিশ, ধাপে ধাপে দাম বাড়ালে জনগণের জন্য সহনীয় হবে। ফলে চলতি বছর কয়েক ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির ভর্তুকির প্রয়োজন ছিল ৩৯৫৩৫ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৯৪২ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। গেল ১৫ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে বিদ্যুতে আমদানি করা জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়ে জ্বালানির দাম। ফলে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ ও গ্রাহক পর্যায়ে দাম। প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম হয়েছে ৮.২৫ পয়সা। ২০১০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম ১২ বার বেড়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম নির্বাহী আদেশে বাড়ে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি।
বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর দাম ৫ শতাংশ বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ডলারের দাম এত বেশি বেড়ে গেছে যে জ্বালানির দাম সহনীয় থাকলেও লোকসান হচ্ছে। সেজন্য দাম সমন্বয় করা হচ্ছে, যা মার্চ থেকে কার্যকর হবে।
জানা গেছে, ২০০ ইউনিটের ওপর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের দাম বাড়তে পারে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খুচরা দাম ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিট ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিট ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা। সেচে ৪ টাকা ৮২ পয়সা এবং শিল্পে লোড অনুসারে ৮ টাকা থেকে ১৩ টাকা।
বিদ্যুতের দাম বাড়লেও মানুষের জীবনের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, যারা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তাদের দাম বাড়ানো হবে, যাতে যাদের সক্ষমতা কম তারা ভর্তুকি দরে বিদ্যুৎ পায়।
তবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি কমিয়ে, লোড ব্যবস্থাপনা করে এবং ক্যাপাসিটি চার্জের মতো বিতর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান করলেই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসে। গ্রাহকের ওপর তা চাপাতে হয় না।
গ্যাসের দাম বাড়বে
গত বছরের ১৮ জানুয়ারি শিল্পসহ অন্য খাতে গ্যাসের রেকর্ড ১৭৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর কারণে সেসব খাতে ভর্তুকি তেমন লাগছে না। তবে সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আমদানি করা এলএনজিসহ বর্তমানে প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) গ্যাসে সরকারের খরচ হচ্ছে ২৪ টাকা। বিদ্যুতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৪ টাকা। লোকসান কমাতে এই খাতের গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তবে পেট্রোবাংলা চাইছে সিএনজি ও সারেও গ্যাসের দাম বাড়াতে। তবে কৃষির খরচ বাড়বে বলে সরকার এতে রাজি হচ্ছে না।
শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র বা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট, সব ধরনের শিল্প (বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র) গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম এখন ৩০ টাকা। সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ১৬ টাকা। সিএনজিতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪৩ টাকা। আর রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং এক চুলার মাসিক বিল ৯৯০ টাকা, যা ২০২২ সালের ৫ জুন বাড়ানো হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে সব কিছুর দাম বাড়বে। ব্যবসায়ী, শিল্প মালিকসহ সাধারণ মানুষ কেউই এই দাম বাড়ার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে তারা উৎপাদন ধরে রাখতে পারছেন না। রপ্তানি আদেশ বাতিল হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে খরচ আরও বেড়ে যাবে। কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হবে তেলের দাম
আইএমএফ গত সেপ্টেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি (অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা) কার্যকর করার শর্ত দিয়েছিল। আইএমএফের শর্ত পূরণে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনসহ জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয় সরকার। শুরুতে এটি তিন মাস পরপর নির্ধারণের পরিকল্পনা ছিল। এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
দাম নির্ধারণ পদ্ধতির বিষয়ে বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তেলের দাম নির্ধারণের দুটি অংশ থাকবে। প্রিমিয়াম (জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য), ট্যাক্স, বিপণন মার্জিন, ডিলারদের কমিশন ইত্যাদি মিলে একটি নির্ধারিত অংশ থাকবে, যা সাধারণত পরিবর্তন হবে না। অপর অংশটি আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়বে বা কমবে। ফর্মুলা প্রণয়নে ভারতের জ্বালানি তেলের দরও বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নসরুল হামিদ বলেন, মার্চ থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করা হবে জ্বালানি তেলের দাম। নতুন দর প্রথম সপ্তাহ থেকেই কার্যকর করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে, আর কমে গেলে কমবে।
এখন আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী সমন্বয় করা হলে দাম বাড়বে, নাকি কমে আসবে– এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ট্যারিফ ভ্যালু ধরে ফর্মুলা হলে দাম বাড়বে, তবে ইনভয়েস ভ্যালু ধরে ফর্মুলা হলে দাম নাও বাড়তে পারে। এখন দেশের বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯, অকটেন ১৩০ এবং পেট্রোল ১২৫ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি ব্যারেল ৭৯ থেকে ৮৩ ডলারের মধ্যে।
সমকাল