গোশত খাওয়াতে মন চায়, কিন্তু সামর্থ্য হয় না

  • সাইফুল ইসলাম তানভীর
  •  ২৬ এপ্রিল ২০২২, ২০:২০

৯ এপ্রিল দেশের নামকরা এক দৈনিক পত্রিকার অনলাইনে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘সন্তানদের গরুর গোশত খাওয়াইতে মন চায়; কিন্তু সামর্থ্য হয় না।’ প্রতিবেদন পড়ে জানতে পারলাম সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় কিছু কমমূল্যে গরুর গোশত, মুরগির গোশত, ডিম, দুধ, খাসির গোশত বিক্রি করছে। তখন একজন রিকশাচালক গরুর গোশত ক্রয় করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পকেট হাতিয়ে দেখেন পর্যাপ্ত টাকা নেই। সেখানে সেদিন ৫৫০ টাকা দরে গরুর গোশত বিক্রি করা হয়েছে। সেই রিকশাচালক সেদিন বললেন তার মেয়েটা প্রায় ছয় মাস ধরে গরুর গোশত খেতে চায় কিন্তু ক্রয়ের ক্ষমতা তার হয়ে ওঠে না। মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে। তিনি সেদিন গোশত বিক্রেতাদের বললেন, আপনারা কি আগামী দিনও গরুর গোশত বিক্রি করবেন?

গণমাধ্যমে এমন অনেক কষ্ট দুঃখের খবর নিয়মিত দেখা যায়। যেমন বরিশালের বানারীপাড়ার এক রিকশাচালক বাবার মেয়ে মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার শুনেও মানুষ দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়েছে।

কক্সবাজারে যে যুবক বললেন আমি রোজাদার। আমি অনেক দুর্বল। ইফতারটা করতে দেও তারপর আমাকে মারো। ওরা তার কথা শুনল না। তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করল। পিটিয়ে হত্যার ভিডিওটা আমি দেখতে সাহস পাইনি। সহ্য করতে পারব না।

আজকে আমাদের স্বাধীনতার বয়স একান্ন বছর। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কিন্তু আমরা আজ কী ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করছি? আমরা কি নাগরিক সুবিধা পাচ্ছি? ১৯৪৭-১৯৭১ সময়ে পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচারী শাসকরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর জুলুম করত। আজকে কারা জুলুম করছে? আজকে গরুর গোশতের কেজি কেন ৭০০-৮০০ টাকা? কারা চাঁদাবাজি করছে যার কারণে গরুর গোশতের এত দাম? পণ্য বোঝাই পরিবহন থেকে কারা কারা চাঁদাবাজি করছে সেটা নিয়ে মাত্র কয়েক দিন আগেও দেশের নামকরা একটি গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। কর্তৃপক্ষ কি কোনো ভূমিকা নিয়েছে?

সড়কে হাজার রকমের চাঁদাবাজি হয়। সেসব চাঁদাবাজি নিয়ে বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নীরবতা দেখি। দুই বছর পূর্বে কসাইদের সংগঠনের সভাপতি বলেছেন, চাঁদাবাজি না হলে আমরা গরুর গোশত কেজি ৩০০ টাকা খাওয়াতে পারব। আমাদের দেশে প্রচুর গরু পালন করা হয়। এত গরুর খামার অতীতে ছিল না। প্রতি কোরবানির ঈদে আমরা দেখি ব্যবসায়ীরা কম দামে গরু বিক্রি করে কাঁদছে। অথচ দেশের লাখ লাখ পরিবার আজ গরুর গোশত খেতে পারে না। বাজারে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি ঘটে গেছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ব্যাংকের কর্মচারীদেরও বেতন বেড়েছে অনেক। কিন্তু অনন্য কয়েক কোটি সাধারণ মানুষের ইনকাম বাড়েনি। এসব মিলিয়ে বাংলাদেশের বাজারে এখন যে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে এটা অতীতের সব চরম মূল্যস্ফীতিকে হার মানিয়েছে। শ্রীলঙ্কা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে এটা বিশ্ববাসী জানেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে কয়েক বছর যাবৎ শ্রীলঙ্কা স্টাইল চলছে। চার দিকে হাহাকার চলছে। কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের চিৎকার। টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্ত পরিবারের লাখ লাখ মানুষের ঢল। টিসিবির সামনের কাতারে দাঁড়িয়েও ৩ ঘণ্টায় সামান্য কিছু কিনতে পারছে না কেউ কেউ। পুষ্টিহীনতায় দেশের লাখ লাখ শিশু। অনেক পরিবার আছে ঈদের দিনও গরুর গোশত খেতে পারে না। এ দেশে ধনীরা কোরবানির নামে পারিবারিক গোশত উৎসব করে। তারা তাদের বাসার ফ্রিজ গোশত দিয়ে ভরে রাখে। আশপাশের দরিদ্রদের খোঁজখবর নেয় না। এটা বাস্তবতা। এটা কোনো বানিয়ে বলা গল্প নয়। আমাদের সমাজে এমন নিষ্ঠুর ধনী লোকের অভাব নেই। কৃষির বিশাল উন্নয়ন হয়েছে। ব্যাপক ফলন হয়। তার পরও এ দেশে আজ খাবার পাচ্ছে না মানুষ।

আমাদের সমাজ রাষ্ট্রে আজ বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আমার মনে পড়ছে আমি ২০০৫ সালে ঢাকার বনানীতে এক করপোরেট অফিসে চাকরি করি। ওই অফিসের ক্লিনার লিটন তার বাসার গল্প করত আমাদের সাথে। সে প্রতি শুক্রবার পাঁচ কেজি গরুর গোশত কিনত। তার দুই স্ত্রী ছিল। ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন নিয়ে শুক্রবার বাসায় বেশ জমিয়ে পোলাও গরুর গোশত খেত। তার বাসা ছিল কড়াইল বস্তিতে। সম্প্রতি কয়েক মাস পূর্বে তার সাথে অনেক বছর পর দেখা। সে বনানী গুলশানে রিকশাচালায়। হলুদ রঙের রিকশা। তার চেহারায় অপুষ্টির ছাপ। শরীরে তেমন শক্তি নেই। সে এখন বলছে, স্যার এহন সংসার চালাইতে পারি না। ইনকাম কম। গরুর গোশত কয়েক মাসেও কিনতে পারি না।

পুরনো দুর্ভিক্ষের কথা শুনেছি। চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষের কথা শুনেছি। এখন বাংলাদেশে টানা কয়েকটি বছরই চুয়াত্তর সাল চলছে। শুধু বাইশ সাল নয়। সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভিক্ষার থালা নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছেন। জানি না এই দুর্ভিক্ষ এই ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি থেকে এই জাতি কখন মুক্তি পাবে।