গোপাল ভাঁড়ও এভাবেই রাজার সমালোচনা করতেন
ফরহাদ মজহার 20 October (on facebook)
একটা পুরানা লেখা পাঠকদের পড়াতে চাইছি। লেখাটি ৭ জুন ২০১৪ দৈনিক যুগান্তরে উপসম্পাদকীয় হিশাবে ছাপা হয়েছিল। গোপাল ভাঁড় নিয়ে।
‘গোপাল ভাঁড়’ রসিক সন্দেহ নাই, কিন্তু গোপাল শুধু হাসায় না, দার্শনিক আগ্রহও জাগায়। কিন্তু গোপাল নিয়ে মনের মতো কিছু লেখা হোল না। এই লেখাটি কবে লিখেছিলাম নিজেই ভুলে গিয়েছি। মোহাম্মদ রোমেল মনে করে দিয়েছেন এবং জোগাড়ও করে দিয়েছেন। রোমেলকে অশেষ ধন্যবাদ।
সাম্প্রতিক কালে ‘ভাঁড়’, বিশেষত রাজকীয় ভাঁড়ামির দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে নতুন করে ভাবা জরুরী হয়ে পড়েছে। রাজা যখন একই সঙ্গে শাসক, আইনদাতা ও বিচারক তখন কিভাবে আপনি আপনার কথা পেশ করবেন? আপনাকে তখন ভান করতে হবে, আপনি সিরিয়াসলি কিছু বলছেন না, আপনার উদ্দেশ্য একান্তই রাজার বিনোদন, রাজাকে আনন্দ দেওয়া। রাজার দিন গত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাও একই পরিস্থিতি তৈরি করে। একটি সমাজে দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যখন রাজার বিনোদনে নিষ্ঠ, তখন সেটা একই সঙ্গে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার চরিত্রও বটে। আপনি ভাঁড়ামিকে আধুনিক কেন্দ্রীভুত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে আলাদা করলে ভুল করবেন। বুঝতে হবে এমন এক চরম কেন্দ্রীভূত ‘রাজকীয়’ শক্তি অধিষ্ঠিত রয়েছে যার সম্পর্কে সত্য কথা বললে আপনার গর্দান যেতে পারে।
আপনি গোপনে রাজার বিরুদ্ধে অনেক কথাই বলতে পারেন, যেমন ধরুন ফেইক ফেইসবুক আইডি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কষে গালিগালাজ করলেন। ডিজিটাল আইন বা ৫৭ ধারা আপনাকে স্পর্শ করলো না। এর দ্বারা সমাজ বিশেষ অগ্রসর হয় না। তাই ‘দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা’ বলতে আমরা বোঝাতে চাইছে আধুনিক কালে রাজার দরবারে স্বনামে সবার সামনে ভাঁড়ামি করবার পরিসর। বঙ্গীয় পরিমণ্ডলের গোপাল যে পরিসরে ভাঁড়ামি করেছিলেন, তাকে রাজার দরবার বলে গণ্য করি। তবে বাড়তি অর্থ এতোটুকুই যে গোপালের গল্প আম জনতা জানতে পারে। হাসে এবং ভাবে। নইলে আমরা এখন গোপাল ভাঁড়ের গল্প পেলাম কোথা থেকে? এখনও আমরা রাজার দুর্দশা ভেবে হাসি। গোপালের বুদ্ধির তারিফ করি।
আধুনিক কালে রাজার দরবারের ভুমিকাটা পালন করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমই এই ক্ষেত্রে ‘রাজার দরবার’। ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করতে চাইলে টেলিভিশনের যে কোন একটি ‘টক শো’ দেখে নিতে পারেন। গোপাল ভাঁড় সিন্ড্রোম নিয়ে আলোচনা আসলে ক্ষমতার সঙ্গে বুদ্ধির চর্চা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্পর্ক নিয়ে তর্ক। এই তর্ক ক্ষমতা বিচারের তর্ককে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ স্তরে নিতে পারে।
লেখাটি আবার ছাপার উদ্দেশ্য আসলে ঐ তর্কে ফিরে যাওয়া। আপাতত পুরানা লেখাটি এখানে পেশ করছি – ফ.ম।