গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক সপ্তাহ পরিবারের প্রত্যাশা, গুমের সাথে জড়িতদের একদিন বিচার হবে

 আমার দেশ
২৭ মে ২০২৩

গুম হওয়া ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন কিনা এই উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন স্বজনরা

গুম হওয়া ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন কিনা এই উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন স্বজনরা

নিজস্ব প্রতিনিধি

“আমি আমার স্বামীর খোঁজ নেওয়া বন্ধ করিনি। যতদিন বেঁচে থাকব তাঁর খোঁজ করতে থাকবো। তাঁর অপেক্ষায় থাকবো আমরা সবাই।”

শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে র‌্যাবের হাতে গুম হওয়া বিএনপি নেতা পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা হোসেন কথাগুলো বললেন।

গত ১৪ বছরে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী অনেককে শেখ হাসিনার সরকার র‌্যাব, পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গুলোকে ব্যবহার করে গুম করেছে।

গুম হওয়া হতভাগ্যদেরই একজন পারভেজ হোসেন। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানী থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হয় তাঁকে। এর একমাস পর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

গুম হওয়া ব্যক্তিরা বেঁচে আছেন কিনা জানেন না তাদের স্বজনরা। বেঁচে আছে, নাকি চিরতরে হারিয়ে গেছে, এই উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন তারা।

বুধবার (২৪ মে) আমার দেশ এর প্রতিবেদককে ফারজানা হোসেন বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীই আমার স্বামীকে গুম করেছে। অথচ গুম করার পর উল্টা স্থানীয় পুলিশ শুরুর দিকে আমাদের পরিবারকে অনেক হয়রানি করতো। কয়দিন পরপর আসতো বাসায়। পারভেজের খোঁজ নিতো। এমন ভাব করতো যে পারভেজ যেন ইচ্ছা করেই লুকিয়ে আছে।”

তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমার সাথে এখনও যোগাযোগ করে। থানায় কোনো নতুন ওসি আসলেই আমাদের বাসায় এসে অদ্ভুত সব কথাবার্তা জিজ্ঞাসা করে। তারা জানতে চায় পারভেজ কি আমাদের সাথে যোগাযোগ করে কি না! ফোন করে কি না! কিছুদিন পর পর আমার শাশুড়ির বাসায় পুলিশ এসে শাশুড়ির কাছ থেকে আমার মোবাইল নাম্বার নেয় এবং আমাকে ফোন করে এমন অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে।”

স্বামী গুম হওয়ার পর পরিবারে নেমে এসেছে অর্থনৈতিক কষ্ট।

তিনি বলেন, “পারভেজ গুম হওয়ার পর আমি আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে আসি। বাবার বাড়ি আসার পরে আমার বাবা তিন বছর পরে মারা যান। আমার কোনো বড় ভাই নেই। আমার দুইটা ছোট বোন। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। এখন আমি আমার ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে থাকি দুই বাচ্চা নিয়ে। ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে থাকাটা যে কি কষ্টের তা বলে প্রকাশ করতে পারবো না। আমি নিরুপায় হয়ে ছোট বোনের শ্বশুর বাড়িতে আছি। ছোট বোনের জামাই আমার দুই ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ দেয়।”

হতভাগ্য এই নারী আরও বলেন, “আমার স্বামীর গুম হওয়ার পর যখন আমি আমার বাবার বাড়ি চলে আসি তখন আমার বাবার বাড়ির এলাকা লোকজন বলতো আমার স্বামী নাকি আমার দুই ছেলে মেয়ে আর আমাকে রেখে চলে গেছে। এসব কথা শুনে আমার বাবা কাঁদতেন। আমার স্বামী গুম হওয়ার পর বেশ আর্থিক কষ্ট হয়েছিল। এরপর বাবা মারা যাওয়ার পর সেই কষ্ট অনেক বেড়েছে। ”

তিনি বলেন, “সরকার পরিবর্তন হলে গুমে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের যথাযথ বিচারের প্রত্যাশা করি। এইবার যদি সরকার পরিবর্তন না হয় তাহলে আমাদের বেঁচে থাকাটাই অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা কারো কাছে বিচার পাবো না। ”

গুম হওয়া পরিবারের সব সদস্যের প্রায় একই গল্প। সবাই বছরের পর পর স্বজনের অপেক্ষায় দিন পার করছেন। তাঁদের এই কষ্ট ভাগাভাগি করার মতো কেউই নেই।

শেখ হাসিনার নির্দেশে গুম হওয়া বিএনপির আরেক কর্মীর নাম মোহাম্মদ সোহেল ওরফে চাচা সোহেল।

প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর রাজধানী থেকে বিরোধী জোটের একাধিক নেতা ও কর্মীকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় চাচা সোহেলকেও শাহবাগ থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। এরপর থেকে আজও সন্ধান মেলেনি তার।

তাঁর স্ত্রী শিল্পী আক্তার বুধবার (২৪শে মে) আমার দেশ কে বলেন, “আমি এখনও আমার স্বামীর খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। এখনও বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে দেখি তাঁকে পাওয়া যায় কি না! ”

তিনি বলেন, “স্বামী গুম হওয়ার পর অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে আমাকে। আমাদের অর্থনৈতিক ও মানসিক অবস্থা একদম ভেঙ্গে পড়েছে। ”

এর সরকারের পতন হলে আমি আমার স্বামীকে ফিরে পাবার প্রত্যাশা করি। গুমে জড়িতদের কঠোর বিচার দাবি করছি।