সালেহ উদ্দিন :রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যে প্রচেষ্টা তা অবজ্ঞা করা হচ্ছে। সমঝোতার বদলে তৈরি হয়েছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। প্রশাসনের দমন-পীড়ন, কঠোর এবং একপক্ষীয় পদক্ষেপে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভারসাম্যও বিনষ্ট হচ্ছে। এর ফলে দেশ গভীর এক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর দুই সপ্তাহ পর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যদিও গেল সপ্তাহে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি যখন এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন তখনো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত ছিল না। বিরোধী দলের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে পুলিশসহ কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। হরতালের পর তিন দিনের অবরোধ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার অবরোধের প্রথম দিনে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আরও ৩ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোও প্রাণহানি ও সহিংসতার ঘটনায় গভীরভাবে মর্মাহত। তারা মনে করে, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে অর্থবহ সংলাপের গুরুত্ব দিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ দিয়েছিল। সুপারিশে বলা হয়েছিল বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা ও ভিন্নমতকে সম্মান এবং নাগরিকদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে নির্বাচন পরিচালনাসহ সব দল একটি অর্থবহ নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারে এবং নাগরিকদের মধ্যে সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং আসন্ন নির্বাচন হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। মার্কিন পর্যবেক্ষক দল বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অর্জনে সহায়তা করতে একটি রোডম্যাপ তৈরিরও সুপারিশ করেছিল। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং সরকার এই সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছিল। সুপারিশ বাস্তবায়ন বা এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের উপরই বর্তায়। কিন্তু দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বরং মহাসমাবেশে সহিংসতার দায় চাপিয়ে সরকার বিরোধী দলের ওপর এক প্রকার ক্র্যাকডাউনে নেমেছে। সরকার এবং প্রশাসনের এখন একমাত্র লক্ষ্যই হলো কীভাবে বিরোধী দলকে পর্যুদস্ত করা। এ ক’দিনেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শ’খানেক মামলা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা মামলায় আসামি হয়েছেন বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মী। রাজধানীতে বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারে চলছে বাসায় বাসায় তল্লাশি। গ্রামেও গভীর রাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিচ্ছে পুলিশ। এ অবস্থায় তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোথাও বিরোধী দলের নেতাদের না পেয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মহানগর বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে না পেয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা তার ছোট ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার রাজনীতির মাঠ বিরোধী দল শূন্য করতে চাইছে। এখন যে পরিস্থিতি তাতে মনে হয় যে, সরকার নির্বাচন পর্যন্ত দেশটাকে দমন-পীড়নের মধ্যদিয়ে টেনে নিয়ে যাবে।
এ ধরনের আলামত দেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ওই দুটি সময়ের মতো নয়। সে সময় অর্থনৈতিক দুরবস্থা এ পর্যায়ে ছিল না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি খুবই নাজুক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ নাকাল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এসেছে। ডলার সংকটে আমদানির জন্য ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা কঠিন। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে।
মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে চীন ও রাশিয়া ছাড়া আন্তর্জাতিক বিশ্বের অব্যাহত চাপ রয়েছে। ইতিমধ্যে গতকালই স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, গণতন্ত্রের সমর্থনে তারা বাংলাদেশে প্রয়োজনে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘এটা ২০১৪ বা ২০১৮ সাল নয়। কেউ যদি ভাবেন এভাবে দমন-পীড়নের নীতি অনুসরণ করে আবারো বিতর্কিত কায়দায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যাবে, তবে তারা ভুল করবেন। মনে রাখা দরকার, নির্বাচনই শেষ কথা নয়। এখন থেকে তিন মাসের মধ্যে বিভিন্ন রকম পরিস্থিতি তৈরি করা হবে, যার ওপর সকলেই নজর রাখবে। তাছাড়া নির্বাচন আগামীকালই অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। নির্বাচনের আরও তিন মাস বাকি। এই তিন মাসে সরকারের আচরণেই বোঝা যাবে তারা কতোটা নিজেদের শক্তিশালী অনুভব করতে পারে। রাজপথের আধিপত্য এক জিনিস আর সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া আরেক জিনিস। আমার ধারণা, আন্তর্জাতিকভাবেও যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা সরকারের জন্য এক ধরনের নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে।’
সাধারণত আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী যুক্ত হন। সুতরাং এবার কোনো বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন হলে নির্বাচন কমিশন, সরকারের শীর্ষমহলসহ এসব লোকজন জড়িত হয়ে পড়বেন। শান্তিপূর্ণ অবাধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন না হলে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ জোরালো পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। এসব ব্যক্তিবর্গ যদি এসব পদক্ষেপের আওতায় পড়ে যান তাহলে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে বাংলাদেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। যদি এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাহলে আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে এবং দেশের মানুষ অভাবনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে পারেন।