গণমাধ্যমের টিকে থাকার লড়াই

 

 আমার দেশ
 প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০২৩

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক আর ব্রডকাস্ট যতো ভাগই করা হোক সব সাংবাদিকতার জগত পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যোগ হয়েছে মোবাইল সাংবাদিকতা, ইউটিউব কনটেন্ট। দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতার ব্যাকরণ-প্রকরণ খাটছে না। মানুষ বা অডিয়েন্সকে কাছে টানাই হয়ে উঠেছে মূখ্য। স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে গণমানুষের খবর ও তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশন, বিশ্লেষণ এবং প্রচারে অংশগ্রহণের ফলে বাড়ছে সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা। তার ওপর খরচ কমাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার বেড়েছে। কনটেন্ট পৌঁছাতে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় তৈরি হয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহু সংবাদ সংস্থার জন্য সংবাদ তৈরি করছে। রোবট সাংবাদিকতা বিষয়টা সামনের দিনে জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠবে কিনা-গণমাধ্যমে নতুন আলোচনার বিষয়।

মুদ্রণ বা ব্রডকাস্ট সব সাংবাদিকতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন তুমুল প্রতিযোগিতা। গণমাধ্যমে বিভিন্ন পদে অভিষেক ঘটছে শত শত তারুণের। এ ছাড়া কেবল সংবাদপত্রই এখন তাদের কর্মক্ষেত্র নয়। তিন ডজনের মতো স্যাটেলাইট টেলিভিশন, বেশ কটি এফএম রেডিও ছাড়াও যোগ হয়েছে নতুন নতুন অনলাইন মাধ্যম। অন্যান্য গণমাধ্যমের চেয়ে আগেভাগে খবর দেওয়ায় মানুষ একাধিক অনলাইন পত্রিকা পড়ছে। কয়েকটি অনলাইনে স্টিল ছবির সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে অডিও, ভিডিও। চলছে বেশ কটি কমিউনিটি রেডিও-ও।

সময়ের চাহিদা ও দ্রুত উৎকর্ষের সুবাদে প্রিন্ট ইলেকট্রনিক সাংবাদিকতার ধরন-ধারা-ধারণাও পাল্টে গেছে। এ দুই মাধ্যমের ব্যবধান অনেক কমে গেছে। পুঁথিগত ধারণার সঙ্গে মুদ্রণ বা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ব্রডকাস্ট মিডিয়া, সম্প্রচার মাধ্যম ইত্যাদি শ্রেণিবিন্যাস আর টিকছে না। টিভি, রেডিও, অনলাইনগুলো ইলেকট্রনিক জার্নালিজমের পর্যায়েই পড়ছে। আবার বৈশিষ্ট্য ও কাজের পরিধি বিচারে সংবাদপত্রগুলোকেও এখন একবাক্যে প্রিন্ট মিডিয়া নামে সীমাবদ্ধ করা যাচ্ছে না। মুদ্রণ সাংবাদিকদেরও এখন সারাক্ষণ ইলেকট্রনিকবান্ধব হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ব্লগসহ নানা ইলেকট্রনিক ফাংশনে সম্পৃক্ত তারাও।

স্বাধীনতার পর আশির দশকে দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। নব্বইয়ের দশকে এ সংখ্যা যৎসামান্য বাড়তে থাকে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবাদিকতায় আসে একটি আকস্মিক বিকাশ। বিপ্লবও বলা যায়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে একটি বড় পরিবর্তন আসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মুদ্রণ এবং প্রকাশনা আইন সংশোধন এ সেক্টরে রীতিমতো ঝড় তোলে। এর জেরে জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে আঞ্চলিক পত্রিকার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হাল হিসাবে রাজধানী ঢাকায় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত আছে ২৩০টি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক। তথ্য বা ঘটনা হিসেবে এটি নজিরবিহীন। রাজধানীর বাইরে পত্রিকার সংখ্যাগত হিসাবেও বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ছাড়াও কোনো কোনো জেলা শহরে অবস্থা সম্পন্ন একাধিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে।

সব মিলিয়ে গণমাধ্যম বাংলাদেশে এখন শিল্প পর্যায়ে। শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রির নানা উপাদান ও লক্ষণ এ সেক্টরেও উপস্থিত। শিল্প পরিচালনার জন্য দরকার কাঁচামাল। গণমাধ্যমে কাঁচামাল হচ্ছে সংবাদ। সেই কাঁচামালগুলোকে সম্পাদনাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ করেন সাংবাদিকসহ সংবাদকর্মীরা। সে সঙ্গে বিজ্ঞাপন, বাজারজাতকরণসহ অন্যান্য বিভাগে রয়েছেন আরেক দল কর্মী। ব্যতিক্রমী এ শিল্প সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

দায়-দায়িত্ব এবং পেশাদারিত্ব এ তিনটির সঙ্গে এসে গেছে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। যে কারণে নীতিমালার মধ্যেও আসতে হচ্ছে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের। এটিই স্বাভাবিক। বিশ্বে গণমাধ্যমের জন্মের সূচনালগ্ন থেকেই একে আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে নিতে সচেষ্ট ক্ষমতাধররা। তা শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা নয়, প্রশাসন, রাজনীতি, ব্যবসাসহ সব ক্ষমতাধরেরই এটা বৈশিষ্ট্য। কোনো ক্ষমতাবানই সমালোচনা সহ্য করতে চায় না, চেষ্টা করে যেন নিজের অপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছে। সে সঙ্গে চায়, নিজের পক্ষে একতরফা প্রচার এবং বিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। ক্ষমতায় কমতি মনে করলে এ লক্ষ্যে, এমনকি আইন করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ঘটনাও রয়েছে দেশে দেশে।

আইন করে যুক্তরাজ্যের রাজা, রাজকর্মচারী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ উপস্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ব্রিটিশদের এই অঞ্চল ছাড়ার পর পাকিস্তানের উপনিবেশেও তা বলবৎ থেকেছে। খুব বদলায়নি স্বাধীন বাংলাদেশেও। সময়ে সময়ে আইনের বাইরেও নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা বা অপচেষ্টা হয়েছে। এ বাস্তবতায় সারা দুনিয়ায় এখন সরকার, ব্যবসায় বা আমলাতন্ত্র বা অন্য কোনো শক্তির বন্ধনহীন পত্রিকা, টিভি চ্যানেল বা গণমাধ্যম পাওয়া দুষ্কর। সে সঙ্গে অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বা উৎকর্ষও এসেছে অতি নিয়ন্ত্রণ বা নিবর্তনের উতরানোর মধ্য দিয়েই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে গণমাধ্যমের বিকাশ আরো বেশি হয়েছে। ইতিহাস বলছে, গণমাধ্যমের সূচনাই হয়েছে দায়বদ্ধতা, সীমাবদ্ধতা, পরাধীনতা এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সালে রাজা জুলিয়াস সিজারের আমলে সংবাদপত্রের মূল রূপ হাতে লেখা শুরু হয় রাজবেতনে নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে। ‘খাস লেখক’ নামের ওই ব্যক্তিরা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শুধু রাজার পক্ষে খবর সংগ্রহ করে সেগুলো লিখতেন। খাস লেখক মানে আজকের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক বা রিপোর্টার। এগারো শতাব্দীর পর মৌখিক তথ্য প্রচারকাজে নিয়োজিতদের বলা হতো নগর ঘোষক। ঘণ্টা বাজিয়ে লোকজন জড়ো করে সংবাদ পাঠের স্টাইলে রাজা-উজিরদের প্রশংসাসুলভ খবর প্রচার করতেন ওই নগর ঘোষকরা। ধারণাগতভাবে তারা আজকের নিউজপ্রেজেন্টার বা রিপোর্টারের মতো।

সংবাদপত্রের বিকাশকে ক্ষমতাধররা বরাবরই ক্ষতিকারক মনে করে দমন বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। আবার এ দমন-নিয়ন্ত্রণ মোকাবিলার জেরেই যুগে যুগে এসেছে গণমাধ্যমের বিকাশ। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর সংবাদপত্র আধুনিক হলেও রাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারেনি। একদিকে চলেছে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, আরেকদিকে হয়েছে বিকাশ।

অনলাইন, রেডিও, টিভি মাধ্যমের দাপটে সংবাদপত্র চ্যালেঞ্জে পড়েছে, এ সত্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আরো অনেক সত্য। পাঠকের তথ্যক্ষুধা মেটানোর প্রতিযোগিতার দৌড়ে কয়েকটি পত্রিকা উপাদান, আঙ্গিক সবকিছুতে বৈচিত্র্য, পরিবর্তন, পরিবর্ধন যোগ করছে প্রতিনিয়ত। টেলিভিশনগুলো সংবাদ ও অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনতে যারপরনাই প্রতিযোগিতায় মত্ত। নইলে সামনে টিকে থাকা না থাকার শঙ্কা। খবর চটজলদি অডিয়েন্সের কাছে নির্ভুলভাবে পৌঁছাতে পারার প্রতিযোগিতার তাড়নায় রেডিও, টিভি, পত্রিকা, অনলাইনসহ গণমাধ্যমগুলো। এ প্রতিযোগিতায় পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও সমাজের বাস্তব চিত্র উঠে আসবে সেটাই কাম্য।

লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট