৬ এপ্রিল ২০২৩
আরিফুল হক
১৬৫২ টা আঞ্চলিক ভাষা এবং ১৮ টা আঞ্চলিক জাতিসত্তা যেমন- বিহারি, বাঙালী, গুর্খা, মারাঠি, রাজপুত, জাঠ, গুজরাতি, তামিল, ইত্যাদি নিয়ে ভারত একদেশ হয়ে টিকে আছে। কিন্তু মাত্র ১০ টা আঞ্চলিক ভাষা আর ৫ টা আঞ্চলিক জাতিসত্তা যেমন বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্তপ্রদেশ, বালুচ, এই নিয়ে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারলনা। ভেঙে দু’টুকরা হয়ে গেল। কারন কি? কারন গণতন্ত্রের গোল্লাছুট। আর গণতন্ত্রের ‘গোদা’ হওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি।
পাকিস্তান সবেমাত্র সৃষ্টি হয়েছে। তখনও ঠিকমত ডানা মেলতে পারেনি শুরু হয়েগেল গণতন্ত্র নিয়ে মারামারি। শুরু হল হাউকাউ, সংগ্রাম, মারামারি, গোলাগুলি। বেশ কিছু মানুষের জান প্রাণ যাবার পর এল ১৯৫৪সালের সাধারণ নির্বাচন। যে মুসলিমলীগ পাকিস্তান সৃষ্টি করলো তাকেই অগণতান্ত্রিক প্রমান করার জন্য এপার বাংলায় সাজসাজ রব পড়ে গেল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ, শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফতে রব্বানী পার্টি, এক হয়ে যুক্তফ্রন্ট রচনা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করে মাঠে নামলেন।
যুক্তফ্রন্ট জনগণকে শোনালো ২১ দফা মিঠাই এর গল্প। ২১ দফার অন্যতম দফাগুলো ছিল, কোরান-সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাপ কোন আইন করা হবেনা। জমিদারি খাজনা আদায় স্বত্ব উচ্ছেদ করা হবে। পাটের ন্যায্য মূল্য দেয়া হবে। বন্যার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা হবে। শাসনব্যয় হ্রাস করা হবে। কালাকানুন বাতিল করা হবে। স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা হবে। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা মিঠা বাক্যের মিঠাই পেয়ে পূর্ববঙ্গের বাক্যপ্রেমি জনগণ যেন প্রেমে জল হয়ে গলে গেল। হক-ভাসানীর প্রতীক ‘নৌকা’ পানি ছেড়ে মানুষের ঘরেঘরে উঠে এল। বুকেবুকে নৌকা, গলায় গলায় নৌকা। জনগণের নৌকা প্রীতির ঠেলায় যুক্তফ্রন্ট দেশের ২৩৭ টি নির্বাচনী আসনের ২২৩ টিতে জিতে সরকার গঠন করলো। জনগণ ভাবলো গণতন্ত্রের গোল্লা জিতেই গেল।
বিপুল বিজয়ের পর ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল মহাসমারোহে শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হলো। সোহরাওয়ার্দি সাহেব শেরে বাংলাকে বললেন শেখ মুজিবর রহমানকে মন্ত্রীসভায় নিতে হবে। শেরে বাংলা বেঁকে বসলেন। তিনি ওসব মানুষকে মন্ত্রীসভায় স্থান দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। শুরু হলো কোন্দল। শরিকদল আওয়ামীলীগ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বয়কট করলো। শুধু বয়কট করলো না, যুক্তফ্রন্ট সরকারকে কি ভাবে ফাঁদে ফেলা যায় সেই মওকা খুঁজতে লাগল। মাস পার হলনা মওকা একটা এসেই গেল। ২রা মে তারিখের ঘটনা। চকবাজারের এক পানের দোকানির কাছে ৭৫ পয়সা বাকি খেয়েছিল পুলিশ মকবুল আহমদ।
পয়সা চাওয়া নিয়ে বচসা পরে হাতাহাতি। ব্যস, এমন মওকা ছাড়া যায়! এই তুচ্ছ ঘটনা বিরাট রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হলো। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান এক উচ্ছৃঙ্খল জনতার মিছিল নিয়ে, ‘পুলিশি জুলুম চলবেনা’ শ্লোগান তুলে জেলগেট আক্রমণ করে পুলিশের অস্ত্রাগার লুট করতে অগ্রসর হলেন। অনন্যোপায় পুলিশ আত্মরক্ষা এবং নিরাপত্তার খাতিরে গুলি চালাতে বাধ্য হল। গুলি লেগে নিহত হল ৬-৭ বছর এক কিশোর। লাশ পেয়ে নেতার আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠল। কিশোরের লাশ ধামাচাপা দেবার জন্য শেখ মুজিবর রহমানকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করে সে যাত্রা রক্ষা পেল শেরেবাংলার যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু ময়লা সাফ হলনা।
এল ১৯৫৮ সাল। পিটার পল গোমেজ নামের এক কংগ্রেস সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদের মাননীয় স্পীকার আব্দুল হাকিম কে পাগল ঘোষণা করে সংসদে এক প্রস্তাব আনলেন। মজার কথা, সংসদে সে প্রস্তাব গৃহীতও হলো। ব্যস আর যায় কোথায়! পাগলা প্রস্তাব নিয়ে বেধে গেল পাগলা যুদ্ধ। মারামারি, ধস্তাধস্তি, চেয়ার ছোড়াছুড়ি। জনৈক নেতার নির্দেশে এক সদস্য চেয়ার দিয়ে বাড়ি দিলেন ভারপ্রাপ্ত স্পীকার শাহেদ আলি সাহেবের মাথায়। রক্তাক্ত হল সংসদ। রক্তাক্ত অবস্থায় শাহেদ আলি সাহেব কে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ১৯৫৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে স্পীকার শাহেদ আলি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। স্পীকারের মৃত্যুর সাথে গণতন্ত্রের ও অপমৃত্যু ঘটলো। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জারি হল আইউব খাঁনের সামরিক শাসন।
১৯৬০ সালে বেসিক ডেমোক্রেসি নামের এক সীমিত গণতান্ত্রিক প্রথা জারি করে, ১৯৬৫ সালের ২জানুয়ারি আইয়ুব খান এক নির্বাচন দেন। এই নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সারাদেশের ৮০হাজার প্রতিনিধির ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতেমা জিন্না কে পরাস্ত করে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
তাতে গণতন্ত্রের উত্তাপ কমলনা। বিশেষ করে ১৯৬৫সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের পর বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো পাকিস্তান কে দূর্বল রাষ্ট্র করার জন্য দেশটি বিভক্ত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করলো।
সেই সুযোগে এবং জনগণের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের আজীবনের শত্রু ভারতীয় শক্তি এদেশে শক্ত ঘাঁটি গাঁড়ার সুযোগ পেল। তারা দেশটাকে বিচ্ছিন্নতার দিকে টেনে নেয়ার জন্য উচ্চাভিলাষী নেতাদের পেছনে অর্থ সহ নানাভাবে শক্তি ও সাহস যোগাতে লাগল! প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সকল উন্নয়ন কার্যক্রম মাটি চাপা পড়ে গেল। ১৯৬৯ সালে আইউব খানের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী মারামারি খুনোখুনির আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। মারা গেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আসাদ, স্কুল ছাত্র মতিউর, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক জোহা, গৃহবধূ আনোয়ারা প্রমুখ। মারা গেল আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি। আইউব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করলেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জেঃ ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দিলেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার অনেক আলামত দেশের শরীরে দৃশ্যমান হল। যেমন আগরতলা ষড়যন্ত্র, শেখ মুজিবের ৬ দফা, লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক ইত্যাদি। সেসব গায়ে মেখেও নির্বাচন হল। শোনা গিয়েছিল বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে নাকি টুপি এবং লুঙ্গী কেনার টেন্ডার করা হয়েছিল।
যাইহোক, তবে এটা সত্য যে অফুরন্ত কারচুপি ভরা এক নির্বাচন ১৯৭০এর নির্বাচন। একেকজন ২০-৩০ টা করে ভোট দিয়ে আওয়ামীলীগ কে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৮৭ টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের ২৮৮ আসনে জয়যুক্ত করে। শেখ মুজিবর রহমান হয়ে যান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা।
পশ্চিম পাকিস্তানে যেমন শেখ মুজিবের ৬ দফা কোন ভোট পেলোনা, পূর্ব পাকিস্তানে তেমনি ভুট্টোর পিপিপি ৬ দফার বিপরীতে থাকা দল, কোন ভোট পায়নি। সুতরাং গণতন্ত্রের গোল্লাছুটের দুই ‘গোদা’ মিলে সেদিনই পাকিস্তান কে বিচ্ছিন্ন করার কাজ সেরে ফেলেছিল।
পরের ইতিহাস শুধু লাশের ইতিহাস, রক্তভেজা মাটির ইতিহাস। গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে শেখ মুজিব নিজের পরিবারবর্গকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিম্মায় রেখে নিজে পাকিস্তান চলে গেলেন। দেশে তিনলক্ষ মানুষ (কারো মতে ত্রিশ লক্ষ) প্রাণ দিল। বিশ্বের নিষেধ অমান্য করে ৬৫ যুদ্ধের যুদ্ধের বদলা এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার মহা সুযোগ কাজে লাগাতে ছুটে এল ভারত। পরাজিত হল পাকিস্তান বাহিনী। ভেঙ্গে গেল পাকিস্তান। সাথে চুরমার হয়েগেল দেশের অর্থনীতি অবকাঠামো, ব্রিজ, বন্দর রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা। মজবুত অর্থনীতির একটা দেশ, নয় মাস যুদ্ধে ভিখারির দেশে পরিণত হল। সে এক শিক্ষণীয় ইতিহাস। কিন্তু এদেশের মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়না।
বিশ্ব মানচিত্রে পাকিস্তান ভেঙ্গে নতুন দেশ হল বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামীলীগ, যারা এতদিন ভারতে পালিয়েছিলেন তারা দেশে ফিরে এসে সরকার গঠন করলেন ।ফিরে আসি নির্বাচনের কথায়।
যে গণতন্ত্র নিয়ে এত লঙ্কাকাণ্ড সেই সাধের বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ। যারা আওয়ামীলীগের কোলে বসে নির্বাচনী লাড্ডু খেতে চান, তাদের সকলকে আওয়ামীলীগের ১৯৭৩ সালের নির্বাচনটা স্মরণে রাখতে অনুরোধ করবো। সেদিনও নেতারা ভেবেছিল আওয়ামীলীগ যখন এমনিতেই হেরে গেছে তখন যুক্তফ্রন্ট গড়ার দরকারটা কি। নির্বাচন যত কাছে আসতে থাকে আওয়ামী রক্ষীবাহিনী, ক্যাডার বাহিনী, সরকারি প্রশাসন যন্ত্র তত মারমুখী হয়ে উঠতে থাকে। চট্টগ্রাম, খুলনা মংলায় ৭০০ বিরোধী কর্মীকে হত্যা করা হল। ক্রমাগত রাজনৈতিক হত্যা, গুম, নির্যাতন বিরোধী দলগুলো মনে আতঙ্ক ও হতাশা সৃষ্টি করলো। ভোটের ফলাফল ঘোষণা ছিল আরও মজার। ঢাকা-১৫ আসনে শেখ মুজিবর রহমান পেলেন ১লাখ ৫ হাজার ৯৫৮ ভোট। আর ঢাকা-১০ আসনে গাজী গোলাম মোস্তফা পেলেন, ১ লাখ ১০ হাজার২ ৮৪ ভোট। জাতির পিতার চেয়ে বেশি ভোট পাবে? কভিনেহি! তাড়াতাড়ি শেখ মুজিবের ভোট বাড়িয়ে করে দেয়া হল ১ লাখ ১৪হাজার ৯৮২। অথচ ঐ এলাকার ভোটার সংখ্যাও অত ছিলনা। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র মুখথুবড়ে পড়লো। আওয়ামীলীগ ৩০০ আসনের ২৯৩ আসন জয় করে নিল।
শুরু হল আওয়ামী নির্যাতন আর দুঃশাসনের যুগ। তারই রেশ ধরে এল ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কবর রচনার উপর একদলীয় বাকশাল শাসনের যুগ। এককথায় রাজতন্ত্রের যুগ। দেশ বাঁচানোর প্রত্যয় নিয়ে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক কিছু সেনাসদস্য প্রতিকারের জন্য এগিয়ে এলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সংঘর্ষে বাকশাল প্রধান শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন।
আবার রক্তপাত, অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থান, অরাজকতা। সেই দিনগুলো ছিল অন্ধকার বিভীষিকাময় দিন । কালো অন্ধকার ভেদ করে আলোর মশাল হয়ে দেখা দিল১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের দিন ।নতুন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে অভিষিক্ত হলেন সেই জিয়াউর রহমান যিনি মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি হিসাবে দেশের হাল ধরেছিলেন।
জিয়াউর রহমান এল, দেশের বুকে যেন আল্লাহর বরকত ফিরে এল। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল, বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে এল, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে এল, দেশ এগিয়ে চলার প্রেরণা পেল। সততা, সাহসিকতা, দেশপ্রেম ,এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে শুধু দেশের মানুষের মনেই নয়, জিয়াউর রহমান বিশ্ব রাজনৈতিক মহলেও এক অত্যুজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন।
১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজস্ব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বহুদলীয় গণতন্ত্রের নির্বাচন দিলেন। সেই নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে ২০৭ আসন পেয়ে বিজয়ী হল।
মানুষ সুখের দিন দেখতে শুরু করেছিল মাত্র । কিন্তু উন্নয়নের শুরুতেই ছেদ পড়লো। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, সেনাবাহিনীর কিছু স্বার্থপর সদস্যের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। পুনরায় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটলো ।প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানে পর বিএনপির দলের বিচারপতি আব্দুস সাত্তার কিছুদিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেঃ এরশাদ এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেন, এবং সামরিক আইন জারি করলেন।
আবার আন্দোলন, আবার রক্তপাত আবার গণতন্ত্রের জন্য মৃত্যু
চলে আসি ১৯৯০ সালে সারাদেশ ব্যাপী গণঅভ্যূত্থানের কথায়। এই গণঅভ্যূত্থানের ভিতর দিয়ে দেশে জন্ম নিল নতুন নেতৃত্বের। গৃহবধূ থেকে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে উঠলেন গণমানুষের প্রাণের ‘আপোষহীন নেত্রী’। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সেনা শাসক জেঃ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।
বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ এর নেতৃত্বে কেয়ার টেকার সরকার গঠিত হলো। ১৯৯১ সালে ২৭ফেব্রুয়ারি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে যে নির্বাচন হয়, সেটাই ছিল বিশ্বখ্যাত নজিরবিহীন সুষ্ঠু নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিজয় লাভ করে বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। খালেদা জিয়া সরকার গঠনের সময়েই শেখ হাসিনা প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেন-ঝাঁকি দিয়ে ধাক্কা মেরে বিএনপি কে গণতন্ত্র শেখাবেন। আওয়ামীলীগের সেদিনের রেকর্ড করা ১৭৩ দিনের সর্ববৃহৎ লাগাতার হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, বন্দর অচল, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি অচল, সারাদেশে সার পরিবহন বন্ধ, ডিলারদের সার লুট, দেশে সার সংকট। শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে সত্যই গণতন্ত্র শিক্ষা দিলেন। আওয়ামীলীগের গণতন্ত্র কতপ্রকার ও কী কী সেটার আঁচ বুঝে বেগম জিয়া পার্লামেন্টে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার আইন পাস করে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অধীনে নির্বাচন হল ১৯৯৬সালের ১২ জুন। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ ১৪৬ টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে।
এইভাবে ২০০১ সালের নির্বাচনটিও তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় । এবং বিএনপি বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। ২০০৪ সালের ৪ঠা জুন হোটেল শেরাটনের সামনে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে ১৮জন নিরীহ যাত্রীকে পুড়িয়ে মারে আওয়ামী নেতারা ।হাসিনার ওয়াদা ছিল, বিএনপি কে একদিনও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর বেগম জিয়া ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানর পর ভারতের ৭ঘোড়ার ঘটনা ঘটে। যার মাধ্যমে গনতন্ত্রের অবসান এবং ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশ মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সেনাশাসন চলতে থাকে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ অঘোষিত ভাবে বিদেশী শক্তির হাতে চলে যায় ।২০০৮ সালের ২৯ডিসেম্বর এক প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে মইনুদ্দিন -ফকরুদ্দিন গং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ফ্রি-এক্সিট নিয়ে দেশ ছাড়েন।
পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে বলেছিলেন “…I hope you know as much we know how your Govornment came to power. Don’t forget that we helped you congratulating you after the election terming it as a free and fair. But you know PrimeMinister how this election results were Pre-arranged at the behest of our good friend in New Delhi. We acted the way they suggested us.”
শেখ হাসিনার আমলের পরবর্তী নির্বাচনগুলোর বিবরণ দিয়ে আর লেখার কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কোনটা ভোটার বিহীন নির্বাচন, কোনটা দিনের ভোট আগের রাতেই শেষ করা হয়েছে। এভাবে সামনে এসেছে ২০২৪এর নির্বাচন। আবার গণতন্ত্র চাই!
এবার নাকি আমেরিকা বিরোধী দলের সাথে আছে। বিরোধী দল ধরে নিয়েছে এবার বিজয় তাদের পক্ষে।
যে শেখ হাসিনা নিজ মুখে বলে আমি ভোট বুঝিনা আমার ক্ষমতা চাই। যে হাসিনা বেগম খালেদা জিয়ার মত জনপ্রিয় নেত্রীকে ৭বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখতে পারেন, জামায়াতে ইসলামের মত সুসংগঠিত দলের উপর লেবেলের সমস্ত নেতাকে ফাঁসি দিয়ে মারতে পারে। বিডিআর হত্যার মত ঘটনা ঘটিয়ে ৭৪ জন সেনা সদস্য হত্যা করার পরও সরকার চালাতে পারে, তাকে এত সহজ ভাবে নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় বসবেন ভাবছেন যে বিরোধী দল তারা হয় আওয়ামী রাজনীতি বোঝেন না, নয়ত বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের জন্য দুটি পথ মাত্র খোলা আছে ১) দেশব্যাপী গণবিস্ফোরণ, ২) জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী কয়েকটি নির্বাচন।
লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক