ব্যবসায়ীদের কবলে রাজনীতি না রাজনীতিবিদদের কবলে ব্যবসা

  • রিন্টু আনোয়ার
  •  ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০৩

– ছবি : সংগৃহীত

নৈতিকতাবোধ কেন হারিয়ে যাচ্ছে? দেশপ্রেমের কেন এ দশা? কেন গড়ে উঠছে না ন্যায্য সমাজব্যবস্থা? এসব প্রশ্ন নিয়ে সামনে আগুয়ান হওয়ার সামাজিক শক্তিও ফেরারি হয়ে পড়ছে। এসবের কারণ খুঁজতে গেলে সামনে আসে সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতির প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা, সমস্যাগুলোর শিকড় চিহ্নিত করা, সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি। বছরের পর বছর বা যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভ‚ত সমস্যার পরিণতি ভয়াবহ। তা বুঝলেও না মানার অন্ধত্ব রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কোথায় নেবে বা নিতে পারে, তা নিয়ে ভাবনার বিকল্প নেই। মূলত গণমানুষের কল্যাণ ও সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের ধারণা থেকেই ‘রাষ্ট্র’ নামক সঙ্ঘের ব্যুৎপত্তি। রাষ্ট্রকে সফল ও সার্থক করে তোলার জন্যই রাজনীতির পথচলা। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি কাঠামো, যা কোনো সমাজের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে। রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় প্রাক-প্রাচীন যুগে প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের রাজনীতি, চাণক্যের অর্থশাস্ত্র ও চাণক্য নীতি (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এবং কনফুসিয়াসের লেখার মতো দিগন্ত উন্মোচনকারী রচনাগুলোতে। মূলত রাজনৈতিক চর্চাটা সর্বসাম্প্রতিক নয়, বরং এর শেকড় অনেক গভীরে। আমাদের দেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই নেতৃত্ব পরিপক্বতা লাভ করেছিল। সেই পরিপক্ব রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।

আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। বহুল আকাক্সিক্ষত এই স্বাধীনতা আনার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন রাজনীতিবিদরা। তাদের নেতৃত্বেই একাত্তরে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনতা পায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে রাজনীতির অগ্রভাগে চলে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। এদের অনেকেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে অর্থের জোরে রাতারাতি হয়ে গেছেন রাজনীতিবিদ। বাগিয়ে নিয়েছেন সরকারের মন্ত্রিত্ব, সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ। আশির দশক থেকেই রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা শুরু। তারপর থেকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাজনীতিতে বণিকদের সংখ্যা কেবল বেড়েছে- এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে বিভিন্ন জরিপে। এমনটিই মনে করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। আমাদের সংসদ হয়ে গেছে এফবিসিসিআইর একটি বর্ধিত অংশ যেটা কোনোভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না; যা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের দেয়া তথ্য মতে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে মহাজোট থেকে নির্বাচিত ব্যবসায়ী আছেন ১৭৪ জন (৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ) এবং ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত পাঁচজন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া তিনজন পেশায় ব্যবসায়ী। যদিও পরে কিছু আসনে পরিবর্তন হয়েছে, সেখানেও রাজনীতিকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেখা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর যে হার ১৫ শতাংশ ছিল- তা এখন অতীতের সব রেকর্ড পেছনে ফেলে দিয়েছে। অবশ্য সংসদগুলোর ধারাবাহিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৫৪ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। পরে ধারাবাহিকভাবেই এটি বেড়েছে। স্বাধীনতার দুই বছর পর প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে ১৫ শতাংশ ব্যবসায়ী ছিলেন সংসদে।

এরপর সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় ব্যবসায়ী, সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য করা হয়েছে। মাত্র ছয় বছরে ১৯৭৯ সালে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এতে বেড়েছে দুর্বৃত্তায়ন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের পরও সেই একই ধারা দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে এসে ব্যবসায়ী এমপির হার হয়েছে ৪৮ শতাংশ, পরে ২০০১ সালের সংসদে এ হার হয় ৫১ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে মোট এমপির ৬৩ শতাংশই ব্যবসায়ী। দশম জাতীয় সংসদে অর্থাৎ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারা এমপি নির্বাচিত হন তাদের মধ্যে ১৭৭ জন কোনো না কোনো ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন- যা শতকরা হিসাবে ৫৯ শতাংশ।

জানা গেছে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। সেই মন্ত্রিপরিষদেও বেশ কয়েক মন্ত্রী ছিলেন ব্যবসায়ী। একইভাবে আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রিপরিষদে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী রয়েছেন। এখন প্রায় ৬১ শতাংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী। এ ছাড়া বর্তমান ক্ষমতাসীন দলে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেশি। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিষদে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা রয়েছেন। সংগঠনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্যবসায়ী রয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতা হলেও তাদেরকে তৃণমূলের কেউ কেউ চিনে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ দিকে সংসদ আর মন্ত্রিপরিষদে ব্যবসায়ীদের দাপটের কাছে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিকরা।

‘ব্যবসায়ীদের কবলে রাজনীতি’ না ‘রাজনীতিবিদদের কবলে ব্যবসায়’-এর কোনোটাই আসল ব্যাপার নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো ব্যবসায়, রাজনীতি, সব পেশাই আজ দুর্নীতিবাজ দুর্বৃত্তদের কবলে। গোটা দেশটাকেই আজ কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী নানা স্বার্থে লুটপাট, দুর্নীতি, অপরাজনীতি আর সশস্ত্র হিংস্র দুর্বৃত্তায়নে গিলে ফেলেছে। ফলে রাজার নীতি নয়, নীতির রাজার নাম রাজনীতি। সেখানে দিনকে দিন রাজনীতি চলে যাচ্ছে নীতিহীনতার দিকে। রাজনীতির ওপর ভর করে বেড়ে উঠছে দুর্বৃত্ত নামের অরাজনৈতিক ব্যক্তি। রাজনীতি তাদের কাছে অপরাধ-দুর্নীতির-লুটপাটের হাতিয়ার।

সাধারণ মানুষের জীবনমান, নিরাপত্তা, নীতি-নৈতিকতা সেখানে যেন কোনো বিষয়ই নয়। লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাস, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা, সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অধঃপতন ও শূন্যতা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার অভাব দীর্ঘ দিন ধরে জেঁকে বসে আছে। এসব জন্ম দিচ্ছে নিত্যনতুন নৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপরাধ। এসব অপরাধ ধ্বংস করছে সততা, নীতি-নৈতিকতা ও মানবতাবোধ। শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। ছিঁড়ে ফেলছে সামাজিক বুনন। আর অপমৃত্যু ঘটিয়েছে রাজনৈতিক সৌন্দর্যের যেখানে রাজনীতির অর্থই পাল্টে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নষ্ট রাজনীতির ডেরায় বেড়ে ওঠা অপরাধের প্রোডাক্টগুলো শেয়ারবাজার, বিদেশে টাকা পাচার, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লুট, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি, বিচারবহিভর্‚ত হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ক্যাসিনোর সাথে ‘মহামারী বাণিজ্য’ বাংলাদেশকে কলঙ্কতিলক এঁটে দিয়েছে।

চাহিদার সীমানা কম বলে মুক্তির কথা গরিবের বেশি পছন্দ। ‘মুক্তি’ বলতে তারা বোঝে, অভাব থেকে মুক্তি। পেট ভরে দুই বেলা খেতে পারাই স্বাধীনতা। মুক্তি ও স্বাধীনতার দৌড় ছোট হওয়ায় তাদেরকে রাজনীতিতে পণ্য বানানো সহজ। অল্পতেই তুষ্ট করা যায়। গড়ের অঙ্কে আয়-আয়ু, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জরিপ শুনিয়ে মাতিয়ে দেয়া যায়। তাই আদাব-সালামে ক্ষমতাবানকে তেলতেলে করে দেয় তারা। নিজেরা নেতৃত্ব চায় না। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার কথা ভাবে না। এমপি-মন্ত্রীসহ ক্ষমতাবানদের তল্পিবাহক হয়ে, সংখ্যালঘু হয়ে ইহলীলা সাঙ্গ করার নিশ্চয়তা পেলেই যারপরনাই খুশি তারা।

তবে বর্তমানে আমাদের দেশে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে খবর ও তথ্যের শেষ নেই। দারিদ্র্য কমছে, দরিদ্রও কমছে। গরিব খুঁজে পাওয়া যায় না- এমন কিচ্ছাও শোনানো হয়। এ-সংক্রান্ত জরিপ-গবেষণাও প্রচুর। সর্বশেষ এক জরিপে বলা হয়েছে, এক দশকে দেশে অন্তত ১০ হাজার কোটিপতি জন্মেছে। আরেক জরিপ বলছে, এই ১০ হাজারেরই হাজারখানেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ নানা জায়গায় এন্তার অভিযোগ। তাদের উত্তরসূরিও অনেক। স্বার্থ ও শ্রেণী বিবেচনায় তারা সবসময় দলে-বলে শক্তিমান।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তির যাবতীয় সুখ-সম্ভোগ লুটে নিয়েছে এই শ্রেণীটিই। দেশের রাজনীতি চলে গেছে পুরোপুরি তাদের দখলে। আর তাই সংসদেও বেশির ভাগ তারাই। ফলে সময়কে কঠিন করে দিয়েছেন তারা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা রাজনীতিতে সঙ্ঘাত, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা ও রাজনীতিবিদদের অনৈক্যের কারণে ততটা এগিয়েছে কি না, তা নিয়েও রয়েছে নানা মত। আর কেন-ই-বা জনকল্যাণমুখী না হয়ে রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা।

রাজনীতি এখন ব্যবসার সম্প্রসারিত অংশ আর নির্বাচনে জেতার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা। দলগুলোর ভেতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করছে। ফলে রাজনীতি ধনীদের খেলায় পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলার ক্ষয় করছে। অর্থ ও পেশিশক্তির কুশীলবরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখলের সুযোগ পাওয়ায় দলগুলোতে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন জাতির জন্য নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সুশাসনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাটের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকে জনগণের টাকা গচ্ছিত থাকে। সে অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ঋণের আবরণে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুধু সুশাসনের ব্যত্যয় নয়, দেশের অর্থনীতিকেও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি সময় ছিল যখন রাজনীতিকরা গৌরবের সাথে পেশা হিসেবে পরিচয় দিতেন, রাজনীতি। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। একসময়কার অনেক পেশাদার রাজনীতিকও এখন সরাসরি বিভিন্নভাবে ব্যবসায় করছেন। নামে-বেনামে আত্মীয়স্বজনের সাথে তারা ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন, আছেন। মাঠ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একই অবস্থা। এমনকি ডান-বামসহ সব ধরনের নেতাই এখন ঝুঁকছেন ব্যবসার দিকে। দলে দলে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলে যোগ দিচ্ছেন ব্যবসার কারণেই। ছাত্র-যুব সব পর্যায়ের রাজনীতিতেই এখন একই চিত্র। আবার এমপি হওয়ার পরই পাল্টে গেছে কারো কারো পেশা। আগে ব্যবসায় না করলেও এমপি হওয়ার পর জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসার সাথে। নামে-বেনামে গড়ে তোলেন ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান। কোথাও তাদের তেমন বাধায় পড়তে হয় না। থামতেও হয় না। মাঝে মধ্যে শুধু ছন্দপতন হয়। আবার স্টিয়ারিং পেয়েও ঘটনাচক্রে থমকে যেতে হয় অনেককে, গ্রেফতার হয়ে কয়েকজন এখন কারাগারে।

গ্রেফতারের পর অনেকের কাছ থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক কোটি টাকা, বিদেশী মুদ্রা, জাল নোট, অস্ত্র ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এসব অপকর্মের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যসহ অনেক রাঘববোয়াল জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে যারা এদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা পেতেন। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। এসব ঘটনার কোথাও কিন্তু গরিবের সম্পৃক্ততা নেই। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি গরিবদের সঙ্গী করে না। দুষ্ট ও খলনায়ক খোঁজে।

রাজনীতিতে ভিড়লে নানা ধরনের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা হাসিলের সত্যতা এখন ওপেন সিক্রেট। কোনো গোপন ব্যাপার নয়। লজ্জার নয়, বরং গৌরবের। তা সব দলেই। তা ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া দলগুলোতে বেশি। কেবল রাজনীতিকে দুষলে কিছুটা একতরফা হয়ে যায়। দুর্বৃত্তায়ন চলছে জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে। যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, সে তত বড় ক্ষমতাবান। সমাজে সে তত উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত, তত বেশি সালামপ্রাপ্ত। তারা স্তাবক, পারিষদ, অস্ত্রধারী, বন্দুকধারী, লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা পরিবৃত্ত। দেশের নদী, চর, নদীর বালুতট, তার তলদেশ, পাহাড়, বন, শ্মশানঘাট, কবরস্তান- সব দিকেই তাদের নজর। সর্বস্ব খেয়ে ফেলার চণ্ডালতা। কোথায় তাদের ক্ষমতা ও অর্থের উৎস- কারো অজানা নয়। বৈদেশিক ব্যাংকে এই দরিদ্র বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিশাল বিশাল অঙ্কের টাকা দিনে দিনে গচ্ছিত হয়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেছে লাখ লাখ, কোটি কোটি। সেকেন্ড হোম গড়ছে কানাডা, মালয়েশিয়া, আমিরাত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, সাইপ্রাসে। শেয়ারবাজারে, ডেসটিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ, বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির একেকটি উপাখ্যান মাত্র। প্রকাশের বাইরে যে আরো নেই- তার গ্যারান্টি আছে? এসব ঘটনাদৃষ্টে, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও রাজনীতি সমার্থক শব্দ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে গরিবের সীমিত মুক্তি কতদূর এসেছে? ধনী-গরিবের ব্যবধান আসলে কতদূূর কমেছে? এসব প্রশ্ন করাই এখন যেন অবান্তর।

মূলত রাজনৈতিক চিন্তার বন্ধ্যত্বের কারণে দেশ আজ গভীর সঙ্কটে নিপতিত। খুব সহজেই বা সহসাই এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে জন্য দেশের রাজনীতিতে যেমন প্রয়োজন গুণগত পরিবর্তন, তেমনি প্রয়োজন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কি রয়েছে? হ
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com