আলতাফ পারভেজ
এ কথা অনেকেই বলেছি, আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক ধাঁচের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিও ছিল না। এটা স্বতঃস্ফূর্ত। সুতরাং এর কাছ থেকে বিশ্বের অন্যান্য সফল গণবিপ্লবের মতো কিছু আশা করা হবে বাড়তি চাওয়া।
সাধারণ বিবেচনায় এসব কথা অসত্য নয়। চেনা রাজনীতির সংকীর্ণ কারিগরি চোখে এই গণঅভ্যুত্থানকে ওই রকমই মনে হয়। আমি নিজেও দু’এক জায়গায় এ রকম বলেছি। অতীতের গণঅভ্যুত্থান-সাহিত্য আমাদের এ রকমই বুঝিয়েছে-পড়িয়েছে। পুরোনো সেসব বোঝাপড়া নিয়েই আমরা জুলাই-আগস্টের বাংলাদেশকে দেখেছি। সেভাবেই রাজনৈতিক উপসংহার টেনেছি। ‘নতুন’কে মুখস্থ অতীত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে বুঝতে পারি নাই।
অথচ এই স্মৃতি তো এখনও তাজা যে, পুরোনো স্বৈরাচার ও রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো প্রায় এক হাজার মানুষ মেরে একটা সম্ভাব্য বিপ্লব থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমরা সেই ‘না-ঘটা বিপ্লব’কে এখন গণঅভ্যুত্থানের গর্ভে খুন করতে চলেছি নিজেদের আহাম্মকি দিয়ে। এই অর্থে আমাদের সঙ্গে ‘বিদায় নেওয়া স্বৈরাচার’-এর তেমন ফারাক নাই। পুরোনো স্বৈরাচারকে আমরা পেনাল কোড দিয়ে ধরতে চাইছি। আমাদের নিজেদেরও যে ইতিহাস ধরবে– সেই মোকদ্দমা নিয়ে আমরা এখনও বেহুঁশ।
এটা সত্য, ঢাকার রমনা থেকে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আমরা অভ্যুত্থানের শহীদের কথা বলি এখনও। আবার এও বলছি, এরা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিয়ে জীবন দেয় নাই। অর্থাৎ তাদের আমরা রাজনৈতিক নায়ক হিসেবে মেনে নিতে কুণ্ঠিত। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, রাজনৈতিক নায়ক তৈরি হয় রাজনৈতিক দল থেকে। একই কারণে আমরা এও পরোক্ষে বলতে চাইছি– শহীদেরা এমন বেকুব ছিল যে, কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নাই এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে কাতারে-কাতারে চুপচাপ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক সন্ত্রাসী এবং রাষ্ট্রীয় বন্দুকের সামনে নিজেদের সঁপে দিয়ে এসেছিল। ব্যাপারটা কি আসলে তাই? নাকি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে এমন কিছু দার্শনিক উপাদান আছে, যা পুনর্পাঠ দাবি করে।
গণঅভ্যুত্থানে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল?
আমাদের পুরোনো ‘শিক্ষা’ হলো, যে কোনো রাজনীতি লিখিত-পড়িত হতে হবে। পুস্তক আর দলিলপন্থি মানুষ আমরা। সামন্ত প্রভু আর পেশকার-সেরেস্তাদারদের মতো। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে খোদ রাষ্ট্রীয় সংবিধানও কিতাবের মতো করে নাই। ইংল্যান্ড, ইসরায়েল, কানাডার মতো দেশ রাজনৈতিক লক্ষ্য-আদর্শ ছাড়াই কি চলছে যুগের পর যুগ?
সদ্য ফেলে আসা স্বৈরতান্ত্রিক দেড় দশক এবং স্বাধীনতাউত্তর গত পাঁচ দশকে আমাদের সমাজে নীরবে যে পরিবর্তনবাদী রাজনৈতিক বুঝ গড়ে উঠেছে এবং তাকে ঘিরে যে মানুষ রাজনৈতিকভাবে তৈরি হচ্ছে, সেটা আমরা আসলে খেয়াল করি নাই। তার মর্মও বুঝি নাই। আসা-যাওয়ার পথের ধারের নিত্যদিনের দেয়াল লিখন, পোস্টার-ফেস্টুন-চিৎকারকে গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিই নাই। আমরা ধরে নিয়েছি, বিএনপি-আওয়ামী লীগই এ দেশের শেষ কথা। ইউটিউবের হিট-লোভী ভিডিও আর ওয়াজকেও সে রকম তালিকাতে রেখেছিলাম। আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আর নয়াপল্টনই রাজনীতির মাজার।
বছরের পর বছর ধরে দেশজুড়ে চলমান সভা-সেমিনার-পাঠচক্রকে আমরা কিছু স্বপ্নবিলাসী মানুষের পাগলামি হিসেবে দেখেছিলাম কেবল। এসব যে সম্ভাব্য একটা গণঅভ্যুত্থানের দীর্ঘমেয়াদি গর্ভযন্ত্রণা ও প্রস্তুতি– সেই বুঝের ঘাটতি ছিল। মানুষের চিন্তা কিন্তু এ পথেই ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়েছে। ইন্টারনেট জগতে ঢুকে তরুণরা দেখেছে বাংলাদেশ নামের এই ‘প্রায় অন্ধকূপ বানিয়ে রাখা’ জনপদের বাইরেও বড়সড় দুনিয়া আছে। সেখানে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার কিছু প্রচেষ্টাও বেঁচে আছে। সেসব দেখা-বোঝার জায়গা থেকেই তরুণরা বলে উঠেছিল– ‘দেশটা কারও বাপের না!’ এর মানে তো এও, ‘দেশটা সকলের’। এই প্রথম লাখ লাখ ছাত্র-জনতা দেশের প্রায় সকল জেলায় একসঙ্গে বলে উঠল– ‘দেশটা সবার’। এর চেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র আর কী হতে পারে! এটাই তো সে-ই ‘নাগরিকতা’র ঘোষণাপত্র, যা সকল ধর্ম-বর্ণ-ভাষার ঊর্ধ্বে হাজির করতে চায় তার রাষ্ট্রচিন্তাকে। এই চিন্তার ওপর দাঁড়িয়েই রংপুরের সাঈদ এবং সিলেটের রুদ্র সেনরা জীবন দিয়েছে।
ঢাকার আন্দোলনের সমর্থনে কয়েক দিন ধরে খাগড়াছড়িতে পাহাড়িদের যে মিছিল হলো, সেও একই কারণে। ২০২৪-এর আগে এ দেশের ইতিহাসে রাতের পর রাত ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে হল থেকে হাজার হাজার ছাত্রীর মিছিল নিশ্চয়ই বেশিবার হয়নি।
ঐক্যবদ্ধ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল এ রকম সকলের। এই বোঝাপড়া কীভাবে তৈরি হলো? এটা আকাশ থেকে নাজিল হয়নি। এর ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে আমাদের জমিনেই। সেই ব্যাখ্যার নির্যাসটুকু আমলে নেওয়ার সময় এখন।
বাংলাদেশে আমরা এতকাল বহু দল, বহু মতাদর্শ, বহু কর্মসূচি দেখেছি। কিন্তু একটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য ‘ঐক্য’কে মূল পাটাতন হিসেবে বিবেচনার ধারণাটা ২০২৪-এর আগে এত মোটাদাগে কেউ বলে নাই।
উত্তাল জুলাইয়ে নোয়াখালীর মাইজদী, ঢাকার উত্তরা, রাজশাহীর সাহেববাজার মোড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র-জনতা জাতীয় ঐক্যের ওই ঐতিহাসিক বোঝাপড়ার সিলসিলা নিয়েই নেমেছে। তাদের মগজ এবং হাতের মুষ্টি দু’জায়গাতে স্পষ্ট ‘কর্মসূচি’ ছিল এবং সেটা কোটা ব্যবস্থার সংস্কার তো বটেই, এমনকি সে সময়কার সরকারের পদত্যাগের চেয়েও বেশি কিছু ছিল।
আবু সাঈদ যখন দু’হাত মেলে গুলি করতে বলছে, তখন সে আসলে এই রাষ্ট্রকে অস্বীকার করছে। তার মতো সকল মজলুম রাষ্ট্রের যাবতীয় জুলুমকে অর্থহীন করে দিয়েছিল জীবনকে প্রতিদান হিসেবে দিয়ে। তার মানে, তারা গুম-খুন-সাইবার অ্যাক্টের মতো জংলি আইনকানুনের ঊর্ধ্বে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছিল। অথচ আমরা বলছি, গণঅভ্যুত্থানের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নাই। তাহলে শত শত গ্রাফিতি, ডজন ডজন র্যাপ গান কী বলছে? রাজনৈতিক কর্মসূচিকে আমরা কি কেবল পণ্ডিতদের গবেষণা পুস্তকেই খুঁজব?
গণঅভ্যুত্থানের কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল?
গণঅভ্যুত্থানের ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ ছিল– এই তীব্র রাজনৈতিক সত্য মেনে নিলেই কেবল আমরা দ্রুত তার দার্শনিক মর্মটুকুও বুঝতে পারতাম। সেটা বুঝতে জাদুঘর বা আর্কাইভে দৌড়াতে হতো না। চোখ বন্ধ করে কান পাতলে এখনও এই স্লোগান আমরা শুনতে পাব: ‘আমার খায়/ আমার পরে/ আমার বুকেই গুলি করে’। এটা তো নিশ্চিতভাবেই এমন এক জবাবদিহিপূর্ণ রাষ্ট্র-প্রশাসনের কথা বলছে, যার হাতে বন্দুক বা চাবুক থাকবে না। যে প্রশাসন কোনো রাজনৈতিক দল বা পরিবারের পা চাটবে না। ‘আয়নাঘর’ বানাবে না।
আন্দোলনের সময়ে উত্তরবঙ্গের সেই কিশোরী দলের বিখ্যাত ভিডিওর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, যেখানে স্লোগান ছিল: ‘কে এসেছে? কে এসেছে? পুলিশ এসেছে। কী করছে? কী করছে? স্বৈরাচারের পা চাটছে’। এসব স্লোগান কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন ‘পাল্টা-নির্মাণ প্রক্রিয়া’ নির্দেশ করে না? যে নির্মাণ বা মেরামত প্রক্রিয়ার নায়কও হতে চাইছে মিছিলের মানুষগুলোই এই বলে: ‘তুমি কে, আমি কে/ বিকল্প বিকল্প’।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম কোনো দল বা দলীয় নেতার বদলে জনতা নিজেই তার ‘ঘুণে-ধরা নষ্ট সমাজ মেরামতকারী নায়ক’ হয়ে ওঠার ঘোষণা দিচ্ছে। জনতার যৌথ ও সম্মিলিত এই আত্মপ্রকাশকে আমরা কোনো ‘কর্মসূচি’ হিসেবে শনাক্ত করতে পারি নাই এখনও– সেটা এই অর্থে ঠিক যে, এটা পুরোনো ধাঁচের গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়েও অনেক বেশি। এই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ তার নিজের রাজনৈতিক নির্মাতা হয়ে ওঠার ঘোষণা দিল। যে ঘোষণায় স্পষ্ট করে বলা আছে– ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
শত শত অকুতোভয় মৃত্যুর সশস্ত্রতায় ন্যায়বিচারের এত উদ্দাম ঘোষণা বাংলার ইতিহাস আর কবে দেখেছে? চলতি রাজনীতির এই অগ্রগতির জায়গাটা চিহ্নিত করতে না পারলে আমরা শহীদদের আত্মত্যাগের তাৎপর্যটুকু বুঝতে ব্যর্থ হবো এবং নানান ধরনের ব্যক্তিগত-গোষ্ঠীগত সংকীর্ণ ফ্যাসাদে লিপ্ত হবো। যে অনাচার বর্তমানে দেশজুড়ে চলছে।
samakal