শেয়ার বিজ :
দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ রেকর্ড ভেঙেই চলেছে। চলতি বছরের জুন শেষে রেকর্ড খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এতে গত তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকাররা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে নানা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ চাপে আছে। এজন্য খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আবার পুনঃতফসিলকৃত ঋণগুলো খেলাপি হতে শুরু করেছে। আগের চেয়ে এ প্রবণতা বেড়েছে। তাই গত তিন মাসে অস্বাভাবিকভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী অনুযায়ী, গত জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশই এখন খেলাপি, যা আন্তর্জাতিক মনদণ্ডের তিনগুণের বেশি। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় মাসে খেলাপি বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। যদিও এক বছরের ব্যবধানে তা কিছুটা কম বেড়েছে। কারণ সাধারণ ডিসেম্বরে প্রভিশন ঘাটতি কমাতে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখায়।
২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।
তিন মাসে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, হঠাৎ করে এত বেশি খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ বিশ্লেষণ করা হবে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ শুরু করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানান, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে দেয়া হয়েছে। তাই ব্যাংকগুলো অনেক সময় যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রভাবশালীদের ঋণ পুনঃতফসিল করে দেয়। দেখা যায় কিছু দিন পর এসব পুনঃতফসিলকৃত ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। এ প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে, যা পুরো খাতের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই খেলাপি ঋণ দিন দিন অস্বাভাবিক পরিমাণ বাড়তেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ব্যাংক খাতের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এজন্য মূলত দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতি। এ রকম যত সুবিধা দেবে ততই খেলাপি ঋণ বাড়বে। পুনঃতফসিল ঋণও এখন খেলাপি হচ্ছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল পলিসি। পুনঃতফসিল সুবিধা না দিয়ে সরাসরি খেলাপি করার বার্তা দেয়া উচিত ব্যাংকগুলোকে। তা-না করে আরও সুবিধা দেয়া হচ্ছে, যার ফলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খেলাপি হলে ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন সেবা ও ব্যাংকের বিভিন্ন সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি বিমান বা মেট্রোতে চড়াতে দেয়া হয় না। তবে বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র। যারা আইন কানুন মানে না তাদের আরও সুবিধা দেয়া হয়। গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এটা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোর দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। গ্রাহক ঋণ শোধ না করলেও ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়া। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংকিং খাত সংস্কার করা। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে বিশেষ তাগিদ দেয় আইএমএফ, যাতে দেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে। তবে বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টোটা।
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে। যদিও এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত রয়েছে। এটিও রয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।