চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নতুন পলিটব্যুরো নির্বাহী কমিটি দেখে বোঝা যাচ্ছে চীনের নেতৃত্ব এখন সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে কট্টরপন্থী অংশের হাতে। দলের উদারপন্থীরা আরও কোণঠাসা হলো।
২০তম পার্টি কংগ্রেসে সি চিন পিং ‘চীনা জাতির মহান নবজাগরণের’ আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে সম্মেলনে উপস্থিত কারোরই সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণ চোখে পড়েনি। বর্তমান বিশ্ব একটা যুগ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, গত এক শতাব্দীর মধ্যে যেটা ঘটেনি। বিশ্ব এখন ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুতে পৌঁছেছে, যেখানে চীনে জন্য কৌশলগত সুযোগ তৈরি হয়েছে।
গৃহনির্মাণ খাতের ধস চীনের ব্যাংকিং খাতের ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক এই সংকট সি চিন পিংয়ের নাজুকতার বহিঃপ্রকাশ। নিজের চারপাশে অনুগত কমরেডদের জড়ো করা এক বিষয় আর অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়।
বিশৃঙ্খল একটা বিশ্বব্যবস্থায় চীন কীভাবে পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে, তার রূপরেখা কী হবে, সেটা খুব কম ক্ষেত্রেই চীনের নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। চীনের বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অতিগুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশ ঘটে। কিন্তু সেই সমাবেশে চীনের কোনো নেতা তাঁর দেশকে কীভাবে বিশ্ব পরাশক্তিতে পরিণত করবে, সেই রূপরেখা তুলে ধরার সুযোগ নষ্ট করলে, সেটা বিস্ময়কর ঘটনাই।
যাহোক, পূর্বসূরি জিয়াং জেমিন ও হু জিনতাওয়ের তুলনায় সি চিন পিংয়ের দৃঢ়চিত্ত অবস্থান অস্ট্রেলিয়াসহ চীনের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের বিচলিত করছে। নির্দিষ্ট করে বলতে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি সত্যি।
দৃষ্টান্ত হিসেবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা ধরা যাক। দীর্ঘদিন ধরে অঞ্চলটি বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর উত্তেজনার কেন্দ্র হয়ে রয়েছে। বেইজিংয়ের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের আরেকটি ক্ষেত্র হলো তাইওয়ান প্রণালি। সি চিন পিং তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ যদি ২০৩০-এর দশক পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান, তাহলে তার জন্য তাইওয়ান ইস্যুর সমাধান করাটাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সি চিন পিং এমন একজন নেতা, যিনি নিরলসভাবে ক্ষমতা সংহত করে চলেছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ২০০৭ সালে। এর পর থেকে ক্ষমতা সংহত করার কাজটি তিনি নিরলসভাবে করে আসছেন। ২০১২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর ধাপে ধাপে তিনি নিজের ক্ষমতা সংহত করেছেন।
সি চিন পিং এই দৃষ্টিভঙ্গি চীনের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে পেয়েছেন। চীনের অস্বচ্ছ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক সময়ই নিষ্ঠুর রূপ ধারণ করে। ১৯২১ সালে সাংহাইতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যাত্রা শুরু হয়। দলটির ইতিহাসে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রেই সহিংস হয়ে উঠেছে। সি চিন পিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারেই এ ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর বাবা সি চংসিন, মাও সে–তুংয়ের সঙ্গে প্রথম প্রজন্মের পার্টির নেতা ছিলেন। ১৯৬২ সালে শুদ্ধি অভিযানের কবলে পড়েন তিনি। ডানপন্থী উপদল গড়ার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় তিক্ত অভিজ্ঞতা সি চিন পিংকে ভোগ করতে হয়েছিল। ষাটের দশকের তাঁকে ছয় বছরের জন্য গ্রামে থাকতে হয়েছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর তাঁর বাবা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। সি চিন পিংয়ের হিসাব–নিকাশ থেকে ইতিহাস কখনো বাদ যায়নি। আবার বেইজিংয়ে সদ্য শেষ হওয়া পার্টি সম্মেলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকেও তিনি উপেক্ষা করেননি। সম্মেলনটি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। তৃতীয়বারের মতো পার্টির নেতৃত্বে অভিষেকের মাধ্যমে সি চিন পিং চীনের ইতিহাসে আর দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাও সে–তুং ও দেং জিয়াও পিংয়ের উচ্চতায় প্রবেশ করলেন।
তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সি চিং পিংয়ের নীতি চীনকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। তাঁর শূন্য কোভিড নীতির কারণে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। তাঁর এই নীতির কারণে চীনের প্রবৃদ্ধি কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম নিম্নমুখী হয়। বিশ্বব্যাংক প্রথমে পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২২ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে জানিয়েছে, প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
গৃহনির্মাণ খাতের ধস চীনের ব্যাংকিং খাতের ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক এই সংকট সি চিন পিংয়ের নাজুকতার বহিঃপ্রকাশ। নিজের চারপাশে অনুগত কমরেডদের জড়ো করা এক বিষয় আর অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়।
- টনি ওয়াকার, অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ মনোজ দে