কোন্দল চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সামনে হাতে একটি চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলার নেতা। চিঠিটি তিনি দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে চান। স্থানীয় নেতাকর্মীদের স্বাক্ষর নিয়ে তিনি ওই চিঠিটি নিয়ে এসেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- নৌকা প্রতীক পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা দলের অপর নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, দল থেকে বহিষ্কারের কথা বলছেন, বিএনপি-জমায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। চিঠি দিতে আসা ওই নেতা মানবজমিনকে বলেন, সারাজীবন আওয়ামী লীগ করে গেলাম। এখন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়ে যদি বিএনপি-জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয় তাহলে এর থেকে দুঃখের আর কি আছে। জেলায় এমন কোনো নেতা নেই যার কাছে এসবের সমাধান পাবো। বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসেছি দলীয় সভাপতি বরাবর চিঠি লিখে। তিনি নাম প্রকাশ করতে চান না। বলেন, এতে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পাশাপাশি জীবনটাই হুমকির মুখে পড়বে।

তিনি বলেন, দলকে ভালোবাসি। তাই এ ধরনের বিভেদ আমার পক্ষে সহ্য করা কঠিন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের পর শতাধিক চিঠি এসেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। এসব চিঠির বেশিরভাগের বিষয়বস্তু দলীয় কোন্দল সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখা। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশিরভাগ চিঠি লেখা হয়েছে। কিছু চিঠি এসেছে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একই বিষয় নিয়ে খোঁজ নেয়া হয় ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়েও। সেখানেও গত কয়েক দিনে অর্ধশতাধিক চিঠি এসেছে দলীয় কোন্দল আর বিভেদ নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দপ্তর সংশ্লিষ্ট এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত কয়েক দিনে এ ধরনের যেসব চিঠি এসেছে তা আমরা ধানমণ্ডি কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা হয়তো সংশ্লিষ্টদের কাছে ওইসব চিঠি দিয়েছেন। ধানমণ্ডি কার্যালয়ের এক অফিস সহকারী মানবজমিনকে জানান, প্রতিদিনই তো এ ধরনের চিঠি আসছে। আমরা দপ্তর সেক্টরে জমা করি। সেখান থেকে চিঠির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আওয়ামী লীগের কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পাশাপাশি বেশিরভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের হওয়ায় কোন্দল বেড়েছে। এ নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। তবে বিষয়টি নিয়ে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা এরই মধ্যে আমাদের বেশ কয়েক নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কাজ করবো।

এক কেন্দ্রীয় নেতা মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, বিএম মোজাম্মেল ও এসএম কামাল হোসেনকে এ ধরনের কোন্দল নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। এ তালিকা কয়েকদিনের মধ্যে আরও দীর্ঘ হবে। নির্বাচনের বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকি, এর জেরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঝিনাইদহ, রংপুর, বরগুনা, বরিশাল, চাঁপাইনবাগঞ্জ, নওগাঁ, পঞ্চগড়সহ অন্তত দুই ডজন জেলায় নির্বাচন পরবর্তী হামলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব দ্বন্দ্ব সংঘাতে বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হয় কয়েকশ’ মানুষ। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, অনেক এলাকায়ই চরম বিভক্ত হয়ে পড়েছে সংগঠন। নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি বেড়েই চলেছে। কোথাও কোথাও হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাল্টাপাল্টি মামলা। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা কেন্দ্রীয় নেতাদের। পরিস্থিতি আমলে নিয়ে কোন্দল নিরসনে শিগগিরই জেলা-উপজেলায় বর্ধিত সভা এবং কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সফরের মাধ্যমে সংকট সমাধানের চিন্তা-ভাবনা করছে দলটি। তারপরও কাজ না হলে নেতাদের পদ থেকে অব্যাহতি, কমিটি ভেঙে দেয়া এমনকি বহিষ্কারের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও নিতে পারে আওয়ামী লীগ। কোন্দলে লিপ্তদের এভাবে চাপে রাখার কৌশল নিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন জমজমাট করতে দলীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে অংশ নেন কয়েকশ’ স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর মধ্যে দলের বর্তমান এমপি, মন্ত্রিসভার সদস্যসহ দলের হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়ে ৬২ জন নির্বাচিত হন। এর মধ্যে বেশিরভাগ নির্বাচনী এলাকায়ই দলের মধ্যে চরম বিভক্তি তৈরি হয়েছে। নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন এমন অনেক এলাকায়ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ঘিরে দলে বিবদমান দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। ১৫ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত যৌথসভায় এই বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যারা নির্বাচন করেছে, কেউ জয়ী হয়েছে, কেউ জয়ী হতে পারেনি। এখন একজন আরেকজনকে দোষারোপ করা বা কার কী অপরাধ তা খুঁজে বের করা- এসব বন্ধ করতে হবে। আমাদের দল ছাড়া আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। আমরা জনগণের সমর্থন পেয়েছি। এটা কিন্তু কাজের স্বীকৃতি। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের জন্য আমরা কাজ করেছি, সেজন্য দেশের মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে, আমাদের জয়ী করেছে। সেখানে হয়তো কেউ জিততে পেরেছে, কেউ জিততে পারেনি। হারজিত যাই হোক সেটা সবাইকে মেনে নিয়ে অন্তত নিজের দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমরা যদি একে অপরের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি, এটা আমাদের বিরোধী দলকে আরও উৎফুল্ল করবে, তাদের কিছু সুযোগ দেয়া হবে। কারও কারও কষ্ট আছে, কারও কারও আনন্দ আছে। কিন্তু ওই আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, হাসি, কান্না সবকিছু মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। সবাইকে আবার এক হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। মানুষের যে আস্থা-বিশ্বাস আমরা অর্জন করেছি, সেটা যেন কোনোমতে হারিয়ে না যায়।

মানব জমিন