আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে সময় ও খরচ সাশ্রয়ে দেশেই গাড়ি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি)। আমদানি করা একটি বাসের পেছনে খরচ হয় কোটি টাকার বেশি। এবার সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে সংস্থাটি। নিজেরাই চেসিস (বাসের কাঠামো) কিনে বাস তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
প্রাথমিক হিসাবে, দেশে একটি বাস তৈরিতে খরচ হবে প্রায় ৯০ লাখ টাকা এবং এটি সম্পন্ন করতে সময় লাগবে ৪৫ দিন। অপরদিকে, বিদেশ থেকে একটি বাস আমদানিতে ব্যয় হয় প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আর বিদেশ থেকে গাড়ি আনতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ বছর।
বিআরটিসি সূত্র বলছে, দেশে গাড়ি বানাতে কোন যন্ত্রাংশের দাম কেমন হবে, সেই বিষয়ে জানতে চেয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে কোন দেশের অথবা কোম্পানির চেসিস ভালো হবে, কোনটির দাম কত পড়বে। সাধারণত ভারত থেকে আমদানি করা একটি চেসিসের দাম আনুমানিক ৪৩ লাখ টাকা। ভারী যানবাহনের জন্য কিছু উন্নত মডেলের দাম ৮৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে জাপানি কোম্পানি হিনোর মাঝারি ক্ষমতাসম্পন্ন চেচিসের দাম ৩২ থেকে ৪২ লাখ টাকার মধ্যে হতে পারে। মন্ত্রণালয়ের কাছে আগামী দু–এক দিনের মধ্যে খরচের বিষয়টি জানাবে বিআরটিসি।
বিআরটিসির কারিগরি ও অপারেশন শাখার পরিচালক কর্নেল মো. মোবারক হোসেন মজুমদার বলেন, কোনো একটি প্রকল্পের অধীনে বিদেশ থেকে বাস আমদানি করতে গেলে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যেত। এতে বহরে নতুন গাড়ি যুক্ত করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আমরা পরিকল্পনা করেছি, এবার দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা কিভাবে নিজেদের কারখানা বাস নির্মাণ করতে পারি। প্রথমদিকে আমরা ১০টি বাস নির্মাণ করতে চাইলেও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বলছে, একটি বা দুটি বাস নির্মাণ করতে। বিআরটিসির লভ্যাংশের টাকা থেকে এসব বাস নির্মাণ করার উদ্যোগ নিচ্ছি।
সূত্রমতে, ৩০ সিটের বাসগুলো পরিচালনায় মাসে ৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আয় করছে বিআরটিসি। প্রতিবছর এই বাসগুলো ৯৫ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা আয় করছে। এই বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, বেতন-ভাতা পরিশোধ, জ্বালানি মূল্য পরিশোধসহ নানা মেরামতকাজে প্রতিবছর ব্যয় করতে হয় ৭০ লাখ টাকা। এতে প্রতিবছর বিআরটিসির লভ্যাংশ থাকে ২৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা। আর এই বাসের খরচ ওঠাতে সময় লাগছে চার থেকে পাঁচ বছর। তবে দেশে বাস বানালে খরচ কমবে ২২ লাখ টাকা। বিদেশ থেকে একটি বাস আনতে যেখানে প্রায় পাঁচ বছর সময় লাগত, সেখানে দেশে বানালে দেড় মাসের মধ্যেই বাস পাওয়া যাবে।
বাস বানানোর জন্য ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া গাজীপুরের সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা পুনরায় চালু করা হয়েছে। পুরোনো যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন সরঞ্জাম যুক্ত করে কারখানার সক্ষমতা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়া, ঢাকার তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল বলেন, পাঁচ বছর পরপর নতুন গাড়ি আসে আর পুরোনো গাড়িগুলো হারিয়ে যায়। সব গাড়ি ডাম্পিং বা ভাঙারি দরে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন গাড়ি নিয়ে বহর শুরু হয়। এই অবস্থা থেকে বের হতে চায় বিআরটিসি। সে জন্য দেশেই গাড়ি তৈরি করা হবে। বাইরে থেকে একটা দ্বিতল বাস আনতে খরচ হয় প্রায় সোয়া ১ কোটি টাকা। দেশে একই ধরনের একটা বাস বানাতে খরচ হবে ৯০ লাখ টাকা।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান বলেন, বিআরটিসি শুধু চেচিস কিনবে। গাজীপুরে কারখানা বানানোর কাজ শেষ। মন্ত্রণালয়ে খরচের বিবরণ পাঠানো হবে। এরপর এই বিষয়ে টেন্ডার আহ্বান করবে বিআরটিসি। দু-তিন মাসের মধ্যেই বিআরটিসির বহরে নিজেদের বানানো গাড়ি চলবে।
এদিকে বিআরটিসির সক্ষমতা প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, বিআরটিসির নিজস্ব ডিপো আছে, টেকনিশিয়ান আছে, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্কশপও আছে। সেক্ষেত্রে নিজস্ব প্রযুক্তিতে যদি বাসের অ্যাসেম্বলের কাজ (কাঠামো সংযোজন) করা না যায়, তবে লোকবল তো অলস বসে থাকবে!
তিনি বলেন, গত তিন অর্থবছরে বিআরটিসির পরিচালনা কমিটি সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রেখেছে। এখন নিজস্ব প্রযুক্তিতে বাস নির্মাণ করে তারা দেশের গণপরিবহন খাতে পথপ্রদর্শক হতে পারে।
বর্তমানে বিআরটিসির বহরে যাত্রীবাহী বাস রয়েছে ১ হাজার ১৯৪ টি। এসব বাস সুইডেন, জাপান, চীন, কোরিয়া ও ভারত থেকে কেনা হয়েছে। এখন নতুন করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসে (সিএনজি) চালিত ৩৫০টি এবং ভারত থেকে ১০০টি বিদ্যুৎ-চালিত বাস কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এসব বাস আমদানি করতে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সময় লাগে বেশি।
ajker patrika