কোটির নিচে কথা নেই রিয়াদের

logo

স্টাফ রিপোর্টার

৩১ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার

mzamin

facebook sharing button

বাবা ছিলেন দিনমজুর। অভাব-অনটন ও টানাটানির সংসার। নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে পারতো না। মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এইচএসসি শেষ করে চলে আসে ঢাকায়। এসে ভর্তি হয় গুলশানের প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকায় আসার পরও তার টানাটানি করে চলতে হতো। কিন্তু ৫ই আগস্টের পরপরই ভাগ্য বদলে যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তকমা লাগিয়ে চাঁদাবাজিতে নামে। শুধু চাঁদাবাজি নয়, বদলি, নিয়োগ, জমি দখল, জমি উদ্ধার- সবকিছুই তাকে দিয়ে সম্ভব হতো। দলবল নিয়ে গড়ে তোলে একটি চাঁদাবাজি চক্র। আওয়ামী লীগ, ফ্যাসিস্টের দোসর, শেখ হাসিনার সহযোগীসহ নানা তকমা দিয়ে মব সৃষ্টি করে ছোট-বড় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, সরকারি চাকরিজীবী, শিল্পপতিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে আদায় করতো টাকা। এ ছাড়া, সংগঠনের নামে বিভিন্ন অজুহাতেও চাঁদাবাজি করতো। এভাবে প্রায় এক বছরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। তার টাকা ইনকামের হিসাব দেখে খোদ তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও হতভম্ব। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিয়াদের এমন বিস্ময় উত্থান সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। গুলশানের সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছে রিয়াদ ও তার চার সহযোগী। গুলশান থানা পুলিশ তাদেরকে আদালতে হাজির করলে আদালত তাদের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশ রিমান্ডে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে রিয়াদ ও তার সহযোগীরা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নির্ভয়ে চেকের মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকা চাঁদা নিতো রিয়াদ। মামলা, হামলা, মবের ভয় দেখিয়ে যেমন টাকা নিতো তেমনি বদলি, নিয়োগ, জমি দখল, জমি উদ্ধার, বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের নামে টাকা আদায় করতো। রিমান্ডের তথ্য অনুযায়ী সোমবার রাতে পুলিশ রিয়াদের নাখালপাড়ার বাসায় অভিযান চালায়। এ সময় বাসা থেকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার একটি চেক পায় পুলিশ। আগামী ২রা আগস্ট ওই চেকটি ক্যাশ হওয়ার কথা ছিল। গুলশানে আওয়ামীপন্থি এক ব্যবসায়ীর জমি উদ্ধারের জন্য ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয় রিয়াদের সঙ্গে। সেই চুক্তির ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার লেনদেনের চেক ছিল রিয়াদের বাসায়। এ ছাড়াও, পুলিশ তার ঘর থেকে অন্তত ১০টি এফডিআরের স্লিপ পেয়েছে। সেখানে ২০ লাখ টাকার বেশি জমা রয়েছে। গত কয়েক মাসে রিয়াদের একটি বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেই ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তদন্তে জানা গেছে, রিয়াদের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সম্প্রতি ঢুকেছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা। আরও কয়েকটি ব্যাংকেও তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা তার টাকার হিসাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া, রিয়াদের চাঁদাবাজি নিয়ে কাজ শুরু করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৫ই আগস্টের পরপরই টাকা কামানোর মিশনে নামে রিয়াদ। ওই সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ, সহযোগী, ব্যবসায়ীদের ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যা দিয়ে মব সৃষ্টি করে পুলিশে দেয়া, বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের রাজত্ব চলছিল। তখন রিয়াদ দলবল দিয়ে মাঠে নামে। শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরাই নয়, যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না- এমন ব্যক্তিদেরও ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করতো রিয়াদরা। অনেক ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, রিয়াদের চাঁদাবাজির বিষয়টি অনেকটা ওপেন ছিল। কিন্তু নানা কারণে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া যায়নি। কারণ অ্যাকশন নিতে গেলেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে তদবির আসতো। এ ছাড়া যেসব ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা আদায় করতো রিয়াদরা তারাও কাউকে অভিযোগ করতো না। তারা কতো মানুষের স্বর্ণ-টাকা লুট করেছে তার হিসাব নাই। গুলশানের যে বাসায় চাঁদাবাজির জন্য তারা গ্রেপ্তার হয়েছে ওই বাসায় আগেও তারা পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন পুলিশের সামনেই তারা লুটপাট শুরু করেছিল। পরে পুলিশের কারণে তারা লুটপাট করতে পারেনি। যদিও এর দুই আড়াই ঘণ্টা পরে গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে ১০ লাখ টাকা নিয়ে আসে। পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রিয়াদকে শেল্টার দেয়া হতো উচ্চপর্যায় থেকে এবং চাঁদার ভাগ উপর মহলেও যেতো। তাই রিয়াদের এসব অপকর্মের তথ্য জানা সত্ত্বেও সংগঠন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যখন বিষয়টি প্রকাশ্য চলে এসেছে তখন রিয়াদ ও তার সহযোগীদের বহিষ্কার করা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রিয়াদের বাসা থেকে উদ্ধার করা সোয়া ২ কোটি টাকার চারটি চেক রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদের। চেক প্রদানকারী ট্রেড জোনের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদের সই রয়েছে। চেক চারটি জনতা ব্যাংকের। দু’টি চেকে এক কোটি করে দুই কোটি, একটি চেকে ১৫ লাখ ও আরেকটিতে ১০ লাখ টাকার পরিমাণ লেখা আছে। তবে চেকে কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছে ট্রেড জোন নামে। ট্রেড জোনের স্বত্বাধিকারীর নাম আবুল কালাম আজাদ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা রংপুর-৬ আসন ছেড়ে দেয়ার পর উপনির্বাচনে আজাদ এমপি নির্বাচিত হন। আজাদ জানিয়েছেন, গত ২৬শে জুন রিয়াদের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল তার অফিসে ঢুকে তাকে হুমকি দেয়। তারা তখন তাকে বলে, থানায় নিজে যাবেন না আমরা নিয়ে যাবো। তারপর তারা সুর পাল্টে বলে টাকা দিবেন না বাইরে যে ২০০ জন লোক আছে তাদের জুতার বাড়ি চড়-থাপ্পড় খাবেন। তারপর তারা নগদ টাকা না থাকায় মোবাইল ফোন ও ৫ কোটি টাকার চেক নিয়ে যায়। পুলিশ রিয়াদের বাসা থেকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার যে চেক উদ্ধার করেছে সেটি আজাদের।

সমন্বয়ক পরিচয়ে গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে রিয়াদ ও তার সহযোগীরা। শাম্মী আহমেদ দেশের বাইরে আছেন। বাসায় ছিলেন তার স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর। গত ১৭ই জুলাই সকালে বাসায় গিয়ে মব সৃষ্টি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা নিয়ে আসে এ চক্রটি। পরে গত শনিবার সন্ধ্যায় ফের গুলশানের ওই বাসায় চাঁদার টাকা আনতে গিয়ে গুলশান থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় পাঁচ চাঁদাবাজ। তারা হলো- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহীম হোসেন মুন্না, ঢাকা মহানগর শাখার সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী মো. আমিনুল ইসলাম। এদের প্রত্যেককে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আমিনুল ছাড়া অপর চারজন রিমান্ডে রয়েছে। মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে রেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় এখনো পলাতক আছে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) জানে আলম অপু ওরফে কাজী গৌরব অপু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here