আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে ফের ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। কয়েকদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছেন তারা। গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজের শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন। এদিকে গতকাল সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের রায় স্থগিত না করে আপাতত বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। একইসঙ্গে এ বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য আগামী ৪ঠা জুলাই দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত। আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেন তারা। এর আগে একই দাবিতে হাজারো শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে একটি বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদিক্ষণ করে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়।
সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল হাইকোর্টে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
সমাবেশে ঢাবিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ‘আঠারোর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার, মেধা না কোটা? মেধা, মেধা’, ‘সংবিধানের মূলকথা, সুযোগের সমতা, মুক্তিযুদ্ধের মূল কথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে, কোটা প্রথা নিপাত যাক, কোটা প্রথা নিপাত যাক’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
গতকাল কোটাবিরোধী টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিন সরকার। এসময় তিনি বলেন, কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা প্রয়োজনে রক্ত ঝরার মাধ্যমে শেষ হবে। তবুও এই বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবি শিক্ষার্থী সমাজ আদায় করে ছাড়বে।
মাহিন বলেন, আমরা আগামী ৩০শে জুনের মধ্যে এই কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিলের আল্টিমেটাম জানাই। যদি ৩০ তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা না হয় তাহলে আমরা লাগাতার দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কোটাবিরোধী দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বানও জানান এ শিক্ষার্থী।
সমাবেশে ঢাবি ছাত্রী তামান্না আক্তার বলেন, আমি নারী হয়ে বলছি, আমি নারী কোটা চাই না। আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাই। মেধাবীরা যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে উপেক্ষা করে যে রায় দিয়েছে, তা আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলাম।
বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ছাত্র মোয়াজ্জেম হোসেন রিহাম বলেন, আমরা হাইকোর্টের রায়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কোটা প্রথা বিদ্যমান রাখার জন্য, কিন্তু আমাদের প্রশ্ন উনি কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষামন্ত্রী নাকি দুই পারসেন্ট শিক্ষার্থীর মন্ত্রী? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র রিফাত রশিদ বলেন, আমাদের সংবিধানে সরকারি চাকরিতে সমতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আজকে কোটার মাধ্যমে মেধাবীদের অবহেলা করা হচ্ছে। এই ছাত্রসমাজ কোনো দাবি আদায়ে যতবারই রাস্তায় নেমেছে, সেই দাবি আদায় করে রাজপথ ছেড়েছে। আজকেও আমরা কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছি। যদি এই বৈষম্যমূলক কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিল না করা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা এই রাজপথ ছাড়বে না। প্রয়োজনে রক্ত ঝরবে, রাজপথে লাশ পড়বে, তবুও আমরা এই দাবি আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালে আদালতের দেয়া রায় বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও। গতকাল তারা রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০১৮ সালে আমরা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটা সংসদে বাতিল করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মো. রাকিব হোসাইন বলেন, সংবিধানে সরকারি চাকরিতে সমতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজকে কোটার মাধ্যমে মেধাবীদের অবহেলা করা হচ্ছে। এই ছাত্রসমাজ কোনো দাবি আদায়ে যতবারই রাস্তায় নেমেছে সেই দাবি আদায় করে রাজপথ ছেড়েছে। আজকেও আমরা কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছি। যদি এই বৈষম্যমূলক কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিল না করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়বে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসময় কোটা পদ্ধতি বাতিল করা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।
গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্বরে এ মানববন্ধন কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘কোটা প্রথা বাতিল চাই’, ‘বৈষম্য মানি না মানবো না’, ‘কোটার বিরুদ্ধে লড়াই হবে লড়াই চাই’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এসময় উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্ল্লোগানের মাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরেন। তারা চান সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো দেশের স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে না বলে মনে করেন তারা। কোটা নয় বরং মেধাভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন পেতে চায়। কোটা পদ্ধতিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হলে সেটা সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের মেধার অবমূল্যায়ন বলে মত দেন তারা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, কোটা বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় একঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করেও রাখা হয়। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে সকাল ১১টা থেকে একঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
‘জ্বালোরে জ্বালো, আগুন জ্বালো,’ ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কোটা প্রথার পুনর্বহাল বাতিল চাই করতে হবে’ ইত্যাদি স্ল্লোগান দেয়া হয়। এসময় তাদের হাতে বিভিন্ন কোটাবিরোধী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
এসময় নুরুজ্জামান মিরাজের পিঠে লেখা ছিল- “কোটা নিপাত যাক, বৈষম্য দূর কর”। এ যেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি বলছেন তারা। বাংলা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নূর জানান, স্বৈরচারীবিরোধী আন্দোলনে যেমন নুর রাস্তায় নেমে পিঠে লিখেছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ঠিক তেমনি বৈষম্য দূর করে কোটা নিপাত করা হবে। তিনি জানান, বৈষম্য দূর করার জন্যে ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল। আবার সেই বৈষম্য শুরু হয়ে গেছে। কোটা বহাল রেখে দেশকে মেধাশূন্য করা হচ্ছে।
বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, কোনো বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকতে পারে না। তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার যেখানে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল হাইকোর্ট কেন সেই কোটাকে আবার পুনর্বহাল করলো আমরা জানি না। সরকারের সিদ্ধান্তকে হাইকোর্ট বাতিল করেছে। আমরা চাইবো সরকারের পক্ষ থেকে যেন আপিল বিভাগে আপিল করা হয় নয়তো আন্দোলন চলবে। আমরা রাজপথ ছাড়বো না।
তারা আরও বলেন, ২০১৮ সালের রক্তের দাগ আজো শুকায় নাই। টিয়ারশেলের দাগ আজো শুকায় নাই। আমাদের সেই সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পথে। আমাদের ওপর হাইকোর্ট যে রায় চাপিয়ে দিয়েছে আমরা সেই রায় মানি না। যারা কোটাধারী মেধাবী পরিচয় দিতে চান, তাদেরকে বলতে চাই, এই পরিচয় খুবই লজ্জার।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তবে সে সময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য থাকা ৩০ শতাংশ কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার একেবারেই তা বাতিল করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, গত ৫ই জুন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
manabzamin