‘কে লইবে মোর কার্য’

এ শহরের নানা ‘কার্য’-এর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ৯৮০ জন কাউন্সিলর ও ১৩ জন মেয়র প্রার্থী সারা শহরের অলিগলি চষে বেড়াচ্ছেন। শহরের জীবনযাত্রাকে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে দেওয়ার জন্য কত ‘কার্য’-এর ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, তার হিসাব নেই। যে শহর ‘বাসযোগ্যতা’র মাপকাঠিতে বিশ্বমানের বিচারে নিম্ন থেকে দুই বা তিনে অবস্থান করে, সে শহরের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তাঁরা যেভাবে নগরদূষণে অবদান রাখলেন এবং তা নিয়ে উচ্চ আদালত অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য যে ‘রুলটি’ জারি করেছেন, সে বিষয় নিয়েই এ প্রসঙ্গের অবতারণা।

নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে রঙিন পোস্টার করা থেকে বিরত থাকলেও ১৩ জন মেয়র ও ৯৮০ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর লেমিনেটেড পোস্টারের সংখ্যা কত হতে পারে। একটি আনুমানিক হিসাবে দেখা যায়, তা ৫৫ লাখের বেশি বৈ কম নয়। নির্বাচন পর্যন্ত সব প্রার্থী ও সমর্থক সেসব পোস্টার জীবন দিয়ে রক্ষা করবেন, কিন্তু নির্বাচনের পরদিন থেকে এ লেমিনেটেড পোস্টার অপসারণ ও তা পরিবেশসম্মতভাবে ধ্বংসের দায়িত্ব কে নেবেন। শেষ পর্যন্ত তা নগরীর নালা-নর্দমা, সর্বশেষ নদ-নদী দূষিত করবে। নির্বাচিত হয়ে যে ‘কার্য’সমূহ করার ওয়াদা করছেন, তা তো দূরের বাদ্য। পরাজিতদের তো ওয়াদা রক্ষার কোনো গরজই থাকবে না, কিন্তু বিজয়ী এবং পরাজিত সবাই মিলে যে অকার্যটি লেমিনেটেড পোস্টারের মাধ্যমে করে গেলেন, তার ক্ষতিকর প্রভাব ঢাকাবাসীকে ভুগতে হবে অনেক দিন।

মাননীয় আদালত লেমিনেটেড পোস্টারের উৎপাদন (ছাপা) ও প্রদর্শন বন্ধ বা জব্দ কেন করা হবে না, তার কারণ দর্শাতে চার সপ্তাহের রুল জারি করেছেন। ঢাকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রুলটি হলেও এটি সারা দেশের জন্যই করা হয়েছে। তাই এ রুলের নিষ্পত্তির পর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশব্যাপী ‘জননেতাগণ’কর্তৃক ইতিমধ্যে করা এবং ভবিষ্যতে যাঁদের করার কথা, সেসব পোস্টার দূষণ থেকে জাতি মুক্তি পাবে। আশা করি, নির্বাচনের পরদিনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পরিবেশসম্মত উপায়ে লাখ লাখ প্লাস্টিক বা পলিথিন বর্জ্য অপসারণ ও ধ্বংসে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, নতুবা আদালতের আদেশ লঙ্ঘিত হবে। তা ছাড়া, সারা দেশের সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নিজ নিজ শহরের পোস্টার দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এ রুল সবার ওপরই প্রযোজ্য হবে। শুধু নির্বাচনকালীন নয়, অন্য যেকোনো সময়ও ‘জনসেবার’ নামে ওই-জাতীয় পোস্টার টানানো যাবে না। অন্য কোনো টেকসই পথ ধরতে হবে।

বিষয়টির ওপর উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিজ্ঞ আইনজীবীদ্বয়—মনোজ কুমার ভৌমিক ও সুলাইমান হাওলাদারকে ধন্যবাদ। সুয়োমোটো রুল জারি করে উচ্চ আদালত কর্তৃক জাতির ভবিষ্যৎ পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। আমরা এ রুলের নিষ্পত্তির মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার একটি সুন্দর নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করব।

দুই.
নির্বাচন এলে শহর নিয়ে কথার ফুলঝুরি চললেও তা খুবই ক্ষণস্থায়ী। আমাদের নগর-ভাবনা নির্বাচনে শুরু, নির্বাচনেই শেষ। আসলে ঢাকা একটি মালিকানাবিহীন বা লা-ওয়ারিশ শহর। এ শহর আমার। এ শহরের ভালোমন্দের সঙ্গে আমি একাত্ম। এ শহরের ভালোমন্দের সঙ্গে আমার ভালোমন্দ জড়িত—এটি এ শহরের বেশির ভাগ মানুষের (সৈয়দ হকের ভাষায়) ‘করোটি’তে নেই। যাঁরা গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ, এ শহরে তাঁদের ঘরবাড়ি নেই। তাঁরা বহিরাগত শ্রমিক। গ্রামই তাঁদের আসল ঠিকানা। তাঁরা এখানে ভোট দেন না, ট্যাক্সও দেন না। ঈদ-পর্বে তাঁরা ‘দ্যাশে’ চলে যান। এ শহরের সঙ্গে তাঁদের নাড়ির সম্পর্ক নেই। শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে তাঁরা এ শহরের বাসিন্দা।

এ শহরের ওপরতলার একটা বড় অংশ, যাঁরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের এ শহরের বাইরে উন্নত দেশের বড় বড় শহর লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, সিডনি, ক্যানবেরা, অটোয়া, টরন্টোসহ নানা শহরে ঘরবাড়ি রয়েছে। সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজন ওই সব দেশে থাকেন। তাঁরা এ দেশে অনেকটা ট্যুরিস্টের মতো, তাঁরা নাড়ির বন্ধন ছিন্ন না করলেও তা বেশ শিথিল। অনেকের সন্তানের শিক্ষা, নিজের ও পরিবারের চিকিৎসা এ দেশে হয় না। এ দেশে আয়-উপার্জন করেন আর তা অন্য দেশে জমা করেন। তাঁদের অনেকে বাংলা বলতে বা লিখতে চান না। তাঁরা বাংলায় খান, কিন্তু বাংলার গান না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরাই আবার এ দেশের কর্ণধার হতে চান। এ দেশের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ অভিবাসী মন নিয়ে এখন এ দেশে জীবন যাপন করেন। শ্রমজীবী-কর্মজীবীদের মধ্যে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রবল বাসনা কাজ করে। তবে তাঁদের শেষ ঠিকানা বাংলাদেশই থাকে, কিন্তু উচ্চবিত্তদের সাফল্যের ষোলোকলা পূর্ণ হয়, যদি ইউরোপ-আমেরিকার কোনো দেশের একটা পাসপোর্ট হয়।

বিশ্বায়নের এ যুগে শিক্ষা, কর্ম, ভ্রমণ প্রভৃতি কারণে দেশের বাইরে যাওয়া আবশ্যক, কিন্তু আমাদের বিদেশমুখিতার মধ্যে একধরনের দেশবিমুখতা রয়েছে, যা একটি সমাজের জন্য খুব সুখকর হতে পারে না। তাই দেখা যায়, এ দেশ, সমাজ ও এ দেশের শহর-গ্রামকে নিজের মনে করে যাঁরা এ দেশের শহর-গ্রামের মালিকানা অনুভব করেন, তাঁদের সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ দেশের দেশপ্রেমিক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, যাঁদের শক্তি-সামর্থ্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি কম, তাঁরাই হয়তো মনে করেন—আমার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এ দেশের উন্নতি-অবনতির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। তাঁদের শক্তি-সামর্থ্য যত ক্ষুদ্রই হোক, সে শক্তি-সামর্থ্যই এ দেশের কল্যাণে কাজে আসবে। তাই বেশি ওপরের দিকে তাকানোর ভ্রান্তি থেকে বের হতে হবে। এ ভাবনা ভাবতে গিয়ে রবিঠাকুরের সে কবিতাটি কেন যেন বারবার মনে পড়ছিল।

‘কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’

ভাবি, এ দুর্ভাগ্যের নগরীর দুর্বহ ভার কে সত্যিকার অর্থে বহন করবেন। এর এত শত কার্যাবলি কে কাঁধে উঠিয়ে নেবেন। কে এ নগরের প্রতিজন নাগরিককে বলবেন, এগিয়ে দিলাম আমার দুহাত। তুমিও বাড়িয়ে দাও তোমার দুহাত। যুক্ত করি হাতে হাত। মুক্ত করি আমার জল, স্থল ও বায়ু। সরাই যত জঞ্জাল, মারি যত মশা। উন্মুক্ত করি পায়ে চলা পথ। নির্মল করি বায়ু, বাড়ুক পরমায়ু। প্রতিযোগিতা নয়, সর্বত্র সহযোগিতা। গালাগালির বক্তৃতা নয়, নয় হিংসা-বিদ্বেষ। সাম্য-মৈত্রীর সংগীত, কবিতা আর উৎসবের নগরী হোক আমাদের এই ঢাকা।

ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ