কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে বেশির ভাগ ব্যাংক

ঈদুল ফিতরের পরও দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। বরং বেশির ভাগ ব্যাংকেই নগদ টাকার সংকট আরো বেড়েছে। দৈনন্দিন লেনদেন মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করছে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংক। গত সোমবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করা অর্থের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। একই দিন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার (কলমানি) থেকেও সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার নেয়া হয়েছে। চাহিদা তীব্র হওয়ায় কলমানি বাজারের সুদহার এখনো সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। ঈদুল ফিতরের আগে এ সংকট তীব্র হয়। গত ২৭ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড ২৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা ধার নেয় ৪০টিরও বেশি ব্যাংক। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বলা হয়েছিল, ঈদের আগে দেশে নগদ অর্থের লেনদেন বেড়ে যায়। এ কারণে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়ার চাপ বাড়ে। ঈদের পর ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের হাতে চলে যাওয়া নগদ অর্থ ব্যাংকে ফিরবে। তখন তারল্য পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

যদিও ঈদের পর গত এক সপ্তাহে ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বরং এ সময়ে কিছু ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের আলোচনায় থাকা ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন। এ কারণে ওই ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের প্রবাহ কমে গেছে।

একীভূত হওয়ার আলোচনায় থাকা ব্যাংকগুলোর একটি বেসিক ব্যাংক। সরকারের মালিকানাধীন ব্যাংকটি বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের আলোচনা চলছে। এতে বেসিক ব্যাংক থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজ নিজ আমানতের টাকা তুলে নিচ্ছে। চলতি মাসেই ব্যাংকটি থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আবু মো. মোফাজ্জেল বণিক বার্তাকে জানান, ‘বেসিক ব্যাংকের বেশির ভাগ আমানতই সরকারি প্রতিষ্ঠানের। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি থাকায় এখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত রেখেছে। এখন বেসরকারি একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা ছড়িয়ে পড়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের অর্থ তুলে নিতে চিঠি দিচ্ছে। এরই মধ্যে মোটা অংকের আমানত তুলে নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি জানিয়ে বেসিক ব্যাংক পর্ষদ থেকে সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরের পর প্রথম কর্মদিবস তথা ১৫ এপ্রিলও ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের চাহিদা তীব্র ছিল। ওইদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। একই দিন কলমানি বাজার থেকেও ৪ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা ধার করা হয়। এরপর প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারকৃত অর্থের পরিমাণ ১৬ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকায় ওঠানামা করেছে। আর কলমানি বাজার থেকে ধারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা। একদিন মেয়াদি ধারের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ হলেও কলমানি বাজারে চাহিদা অনুযায়ী অর্থ মিলছে না। এজন্যই ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে বাধ্য হচ্ছে।

অর্থ সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো এখন ১১ থেকে ১৩ শতাংশ সুদেও মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করছে। দেশের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা জানিয়েছেন, ১১ শতাংশের বেশি সুদ প্রস্তাব করেও মেয়াদি আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারই এখন সাড়ে ১১ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিশ্রেণীর অনেক গ্রাহকও এখন সরাসরি ট্রেজারি বিল কিনছে। আবার মার্জার-অ্যাকুইজিশনসহ ব্যাংক খাত নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রচারণার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট বাড়ছে।

মূল্যস্ফীতির হার কমানোর কথা বলে গত বছরের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে নীতি সুদহার ৮ শতাংশে উন্নীত করে বাজারে অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়। তারল্য সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির প্রভাবে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে। চলতি এপ্রিলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। সে হিসাবে গত নয় মাসে ঋণের সুদহার ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।

যদিও মূল্যস্ফীতিতে এখনো সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব দৃশ্যমান হয়নি। সর্বশেষ মার্চেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এ নিয়ে টানা ২১ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।

দুই বছর ধরেই দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি শ্লথ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও সেটি ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। এর পেছনে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। সাধারণ মানুষের হাতে সঞ্চয় করার মতো অর্থ থাকছে না। অনেকে ব্যাংক থেকে সঞ্চয় ভেঙে কিংবা ঋণ করেও জীবিকা নির্বাহ করছেন।’

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারল্য নিয়ে দেশের ব্যাংক খাত চাপের মধ্যে রয়েছে। ঈদের পরও চাপ কমেছে বলে মনে হচ্ছে না। সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে। আগামী দুই মাসে ঋণ নেয়ার প্রবণতা আরো বাড়তে পারে। তখন সংকট আরো বেড়ে যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের আয় বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকারকে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’

তারল্য সংকটের মধ্যেই ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে সরকার। ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকির বিপরীতেও সরকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করছে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির কারণে আগামীতে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ২১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা।

সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতায় এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। বছর দুই আগেও ৯১ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল আড়াই শতাংশেরও কম। স্বল্পমেয়াদি এ ঋণের সুদহার এখন ১১ শতাংশের বেশি। মেয়াদ বেশি হলে ঋণ নিতে সরকারকে আরো বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন ব্যক্তি খাতের চেয়ে সরকারকে ঋণ দেয়াকেই বেশি লাভজনক মনে করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলতি মাসে তা ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। সে হিসাবে সবচেয়ে কম মেয়াদি এ বিলের সুদহার বেড়ে হয়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়েছে ২৫৭ শতাংশেরও বেশি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। চলতি এপ্রিলে ছয় মাস মেয়াদি এ বিলের সুদহার ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এক বছর বা ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়েছে ২৩৪ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ মেয়াদের এ বিলের সুদহার ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ থাকলেও তা এখন ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

ইল্ডরেট বা সুদহারের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল ব্যবহার করে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতিও দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে নেয়া সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ৬২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৩৬ হাজার ২১০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ সময়ে সরকারের স্বল্পমেয়াদি এ ঋণ স্থিতি বেড়েছে ৭৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা বা ১১৯ শতাংশ। চলতি এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের নেয়া এ ঋণের স্থিতি আরো স্ফীত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘‌সরকার নিজেই এখন ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। এ চক্র থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজস্ব ঘাটতি সত্ত্বেও সরকার প্রতি বছর বিরাট আকারের বাজেট ঘোষণা করছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে টাকা নেই। এ কারণে উচ্চ সুদে সরকার ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এত বেশি সুদে ঋণ নেয়ার কারণে সরকারের সংকট আরো তীব্র হবে।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‌সরকার ১১ শতাংশের বেশি সুদে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার ৮ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর কাছে এখন সরকারই সবচেয়ে বড় ভোক্তা। আগামী দুই মাসে সরকার ব্যাংক খাত থেকে আরো ৮০-৯০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হবে। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। সে ঋণে দেশের মূল্যস্ফীতি উসকে উঠতে সহায়তা করেছে। এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা নতুন টাকা ছাপাবে না। তার মানে বাজার থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ আমানত বাড়বে, তার পুরোটাই সরকারের ঋণে চলে যাবে।’

এদিকে ‘ব্যাংক একীভূতকরণ’ নিয়ে গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, একীভূতকরণের প্রক্রিয়াধীন ব্যাংকগুলোয় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের জমাকৃত আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। একীভূতকরণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরও নিজ নিজ ব্যাংকের হিসাবধারীদের বর্তমান হিসাব আগের মতো চলমান থাকবে। এছাড়া একীভূতকরণের আওতাভুক্ত ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালক, বর্তমান পর্ষদ ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতির ভিত্তিতেই একীভূতকরণের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।’

Bonik Barta

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here