কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন: ঋণ অবলোপন ৬৫ হাজার কোটি টাকা

jugantor

 হামিদ বিশ্বাস

 ১৬ আগস্ট ২০২৩
ঋণ

ব্যাংক খাতে ২০২২ সালে ঋণ অবলোপন স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। যা ২০২১ সালে ছিল ৬০ হাজার ৪৯৮ কোটি। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ অবলোপন বেড়েছে ৪ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঋণ অবলোপন থেকে আদায় হয় ২০ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। ফলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের অঙ্ক দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৪৯৩ টাকা। এ সময় খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি এবং বকেয়া পুনঃতফশিল করা ঋণ ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। সব মিলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে বিপদগ্রস্ত ঋণ ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। বর্তমানে সে অঙ্ক আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিপদগ্রস্ত ঋণের এ অঙ্ক চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় অর্ধেক। ব্যাংকিং খাত যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা এই চিত্র দেখেই বোঝা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ১৬ হাজার ৪৪৯ কোটি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২৬ হাজার ৫৬৮ কোটি, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১ হাজার ১২৫ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ৩৫১ কোটি টাকা।

গেল দুই বছর বিশ্বব্যাপী আঘাত হানা মহামারি করোনার কারণে ঋণ আদায়ে বিভিন্নভাবে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেসব ছাড় কোনো কাজে আসেনি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বিভিন্ন ছাড় দিয়েও যখন খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না, তখন পুরোনো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ব্যাংকগুলো। ঋণ অবলোপন করে খেলাপি কম দেখানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ কৌশলটির নাম ঋণ অবলোপন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের মন্দমানের খেলাপি ঋণ ৩ বছর ধরে (যা আগে ছিল ৫ বছর) আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজার বুকে সংরক্ষণ করা হয়। এর আগে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন এবং অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করতে হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ নামে পরিচিত। এভাবেই ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছে ব্যাংকগুলো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে আজ এই অবস্থা। উপর মহলের চাপে ঋণ দিয়ে এখন সেই টাকা আর আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। ব্যাংক খাত বাঁচাতে হলে এখন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ঋণখেলাপি, পুনঃতফশিল ও অবলোপনের মতো উচ্চ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়তেই থাকবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসাবে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব দিতে হচ্ছে। এক সময় প্রতি জুনে বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপদগ্রস্ত ঋণের অঙ্ক প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, তা আবার শুরু করা উচিত। জানুয়ারিতে আইএমএফ স্টাফ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, কোভিড-১৯ আর্থিক সহায়তা নীতিমালার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। যেহেতু এই নীতিগুলো শিথিল করায় ব্যাংক ব্যবস্থার লোকসান ধীরে ধীরে উঠে আসতে পারে, তাই সম্পদের শ্রেণিবিন্যাস, বিশেষ করে পুনর্গঠিত ঋণের বর্তমান ব্যালেন্স শিটের ঝুঁকিগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরা উচিত। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ যথাযথভাবে প্রকাশ করা উচিত।

আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপদগ্রস্ত সম্পদের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ প্রকাশ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে সম্পদের গুণগতমানে সামান্য অবনতি হয়েছে। কারণ খেলাপি ঋণের অঙ্ক কিছুটা বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ ছিল। যা ২০২১ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্পে খেলাপি ঋণ ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অন্যসব খেলাপি ঋণের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ।

চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পে খেলাপি ঋণ আছে ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বস্ত্র শিল্পে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও তৈরি পোশাক শিল্পে ১১ দশমিক ১২ শতাংশ।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যা মোট ঋণের ২৫ শতাংশের কম হবে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাচ্ছে মাত্র ৮ শতাংশের একটু বেশি।