কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ৪ শিক্ষার্থীসহ মোট ৭ শিক্ষার্থী গত ২৩ আগস্ট থেকে নিখোঁজ। এ বিষয়ে থানায় জিডি করেছেন পরিবারের সদস্যরা। র্যাব-পুলিশ বলছে, বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে তদন্ত চলছে।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীরা হলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান (১৭) ও সামি (১৮), একই কলেজের অনার্স প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), অনার্স তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম আলামিন (২৩), কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম (১৮) ও নিহাল আবদুল্লাহ (১৭) এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স সম্পন্ন করা সরতাজ ইসলাম নিলয় (২৩)।
পরিবারের সদস্যরা জানান, নিখোঁজ প্রত্যেকেই পূর্বপরিচিত। বাড়ি ছাড়ার সময় তেমন টাকা-পয়সা, সেলফোন কিংবা পোশাক পরিচ্ছদও নিয়ে যায়নি তাদের কেউই।
তারা আরও জানান, নিখোঁজ প্রত্যেকেই অত্যন্ত ধার্মিক। পড়াশোনার বাইরে অন্য বিষয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ তেমন চোখে পড়েনি। তাদের কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতাও নেই।
নিখোঁজ সন্তানদের ফিরে পেতে ইতোমধ্যে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় জিডি করেছেন অভিভাবকরা।
কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা নিবাসী নুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তার ছেলে আমিনুল ইসলাম ২৩ আগস্ট কান্দিরপাড়ে যাওয়ার কথা বলে আর বাসায় ফেরেনি। এ বিষয়ে র্যাব-পুলিশকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো ছেলের খোঁজ মেলেনি।
কুমিল্লা নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, তার ছেলে ইমরান বিন রহমানের তাবলীগের প্রতি কিছুটা ঝোঁক রয়েছে। তবে পড়াশোনা, কলেজ, কোচিং সেন্টার আর মসজিদ ছাড়া সে কোথায় যায় না। তবে অনলাইন ক্লাসের নাম করে মোবাইলে রাত জেগে বিভিন্ন ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল ও আলোচনা শুনতো।
‘কয়েক মাস আগে ইমরানের কাছ থেকে সেলফোনটি নিয়ে নেই। এরপরও সে স্কুল শিক্ষক মায়ের কাছ থেকে সময়ে সময়ে মোবাইল নিয়ে অনলাইন ক্লাস করতো, আর ফাঁকে ফাঁকে ধর্মীয় আলোচনা শুনতো। গত ২৩ আগস্ট দুপুরে আমাকে সে বলে, আমি আজ কোচিং থেকে রেলস্টেশন মসজিদে তাবলীগের বয়ান শুনতে যাব। ফিরতে দেরি হবে, আম্মুকে বলো না। ওইদিন রাত ৮টা পর্যন্ত বাসায় না ফেরায় সারারাত খোঁজ করে না পেয়ে পরদিন কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় জিডি করি। পরে র্যাবকে অবহিত করি’, বলেন তিনি।
এই অভিভাবক আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তানভীর আহমেদকে অবহিত করেছি। র্যাব ও পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করার কথা জানিয়েছে। তারা যখন ডেকেছে, তখন সব তথ্য দিয়ে তাদের সহায়তা করেছি।’
অপর শিক্ষার্থী নিহালের বাবা সাইফুল ইসলামসহ অন্যদের অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন।
নিখোঁজ ৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিলয় ও নিহাল সম্পর্কে খালাতো ভাই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র নিলয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স সম্পন্ন করেছেন।
অভিভাবকদের ধারনা, নিলয়ের নেতৃত্বে বাকি ৬ জন বাড়ি ছেড়েছেন।
এদিকে, একটি বিশ্বস্ত সূত্র ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, কুমিল্লায় র্যারের কাছে অভিযোগ করার ২ দিনের মধ্যেই নিলয়কে তার ঢাকার বাসা থেকে আটক করেছে র্যাব। নিলয় এখন তাদের হেফাজতে আছে।
যদিও র্যাব বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারবেন বলে জানিয়েছেন র্যাব কর্মকর্তারা।
নিহালের বাবা সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, ২৪ আগস্ট ভোরে চাঁদপুর শহরের রেলস্টেশন সংলগ্ন চাঁদপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে হোটেল ম্যানেজার তাকে ফোন করে জানান, নেহালসহ তার বন্ধুদের সেই হোটেলে দিয়ে গেছে পুলিশ।
‘হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাকে ফোন করে বলে যে, আপনার ছেলেকে নিয়ে যান। তখন আমি আমার ভায়রার ছেলে নিলয়ের সঙ্গে কথা বললে সে জানায়, আপনাদের আসতে হবে না। আমরা এখুনি চলে আসতেছি। কিন্তু তারপর আর খবর নেই। এই নিয়ে আজ ১৫ দিন হলো ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না’, বলেন তিনি।
এ বিষয়ে চাঁদপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২৩ আগস্ট রাত পৌনে ২টার দিকে থানার এসআই খায়রুল ইসলাম ৫ জন ছেলেকে এনে বললেন, তারা বাড়ি থেকে অভিমান করে চলে এসেছে। তাদের অভিভাবকদের ফোন দিয়ে জানিয়ে দেন, যাতে সকালে তারা এসে নিয়ে যায়। পরদিন সকাল ৬টায় আমার শিফট শেষ হলে আমি দিনের শিফটের ম্যানেজার হেদায়েত উল্লাহর কাছে তাদের বুঝিয়ে দিয়ে যাই। পরে শুনেছি, আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নাকি তারা হেদায়েত উল্লাহকে বলেছে, আমাদের অভিভাবক এসেছে আমরা চলে যাই। হেদায়েত উল্লাহ মনে করেছেন সত্যি সত্যি তাদের অভিভাবক এসেছে। এজন্য তিনি তাদের চলে যেতে বলেছেন।’
চাঁদপুর নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক খায়রুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সেদিন রাতে আমাদের ফাঁড়ির ইনচার্জ মিন্টু দত্ত স্যারসহ আমরা একটা অভিযানে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি চাঁদপুর কালীবাড়ির সামনে এই ছেলেগুলো ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। তখন স্যার তাদের কাছে জানতে চাইলে কেউ বলে, বাসা কুমিল্লায় আবার কেউ বলে বাসা ঢাকায়, বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম, এখন গাড়ি নেই তাই বসে আছি। তখন ইনচার্জ স্যার আমাকে বললেন, তাদের ওই হোটেলে দিয়ে আসেন, সকালে অভিভাবকদের ফোন করে যাতে ছেড়ে দেয়।’
১৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখনো ৭ শিক্ষার্থীর কোনো খোঁজ মেলেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) তানভীর আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। প্রাথমিক তদন্ত চলছে, এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা র্যাব-১১ সিপিসি-২ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব বলেন, ‘আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে কাজ করছি। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে এ মুহূর্তে কিছু বলতে চাচ্ছি না। আশাকরি দ্রুতই আপনাদের অগ্রগতি জানাতে পারব।’