
চলমান ইস্যুতে খুঁজে পাওয়া গালিব বিন মোহাম্মদ সাহেবের লেখা।
পড়ে দেখতে পারেন 
 গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে বসবাস করা ১৭ কোটি আদমসন্তানের ন্যয় কনফিউজড মানবজাতি এই দুনিয়ার বুকে আর নাই ।
 গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে বসবাস করা ১৭ কোটি আদমসন্তানের ন্যয় কনফিউজড মানবজাতি এই দুনিয়ার বুকে আর নাই ।পাঁচ হাজার বৎসর পূর্ব হইতে এই ভুমির সকল মানুষই মোটামুটি একই সনাতন ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল; সোজা কথায় পাথর, পুতুল আর নানা প্রাকৃতিক শক্তির পূজা-অর্চনায় । মাঝে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়া বেশ কিছু চড়াই-উৎড়াই পার হইলেও মোটাদাগে সেই অবস্থাতেই নির্বিঘ্নে চলিল প্রায় হাজার চারেক বৎসর । নামের আগায় শ্রী লইয়া নম: নম: করিয়া ইহারা বেশ নির্বিঘ্নে কাল কাটাইল ।
তারপর আসিল বারোশো শতক । পারস্য হইতে ‘ঘুরি’ সাম্রাজ্যের সিপাহসালারগণ একে একে কাবুল-হেরাত-দিল্লী দখল করিয়া বাংলা মুলুকে আসিয়া হাজির হইল । রাজা ‘লক্ষণ সেন’ কে হঠাইয়া সেই বিদেশী ঘোড়া-সওয়ারকারী যবনের দল দখল করিল বাংলা মুলুকের সিংহাসন । যদিও তাহাদের এই রাজ্য জয় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নহে, বরং ভারতবর্ষের সম্পদের আকর্ষণেই হইয়াছিল; ঠিক যেমনভাবে ঘুড়িদের ভারত দখলের দুইশ বছর পূর্বেই গজনীর সুলতান মাহমুদ মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করিয়া ইচ্ছামত লুটপাট করিয়া গজনীতে ফিরিয়া গিয়াছিলেন ।
যাহা হোক । ঘুরি’রা সুলতান মাহমুদের মত পারস্যে ফিরিলেন না । তাহারা দিল্লী-বাংলা জয় করিয়া এই স্থানেই আসন গাড়িয়ে বসিলেন ।
কথায় আছে রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম । সুতরাং, দলে দলে ভারতবাসী এবার শাসকের ধর্ম ‘ইসলাম’ গ্রহণ করিতে লাগিলেন । তাহা ছাড়া ‘ইসলাম’ ধর্ম হিসাবেও অনেক উদার, সমতা-সম্পন্ন, জাত-পাত ইত্যাদির অত্যাচার নাই । সুতরাং, বিশেষ করিয়ে নিন্মবর্ণের হিন্দুগণ বর্ণপ্রথার নিপীড়নে অতিষ্ট হইয়া বাপ-দাদার ধর্ম ছাড়িল । সুলতানগণের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই পালে আরও হাওয়া লাগিল ।
কনফিউশনের প্রথম সূত্রপাত হইল ঠিক সেই সময়েই ।
নব্য মুসলমানগণ রাতারাতি ধর্ম তো পাল্টাইলেন কিন্তু মনের ভিতরে দীর্ঘ চারহাজার বছরের আচার-আচরণ-কৃষ্টি-কালচার-রীতিনী তি-আনন্দ-উৎসব-সামাজিকতা ইত্যাদি তো হঠাৎ করিয়া পাল্টানো সম্ভব নহে । এদিককার ভারতীয়-বঙ্গ সমাজে এমন অনেক কিছুই পালন করা হইয়া থাকে, যাহা ঐদিককার পারসিয়ান সমাজে নাই । সুতরাং, কি করা যায় ?
বাঙ্গালী বড়ই বুদ্ধিমান ! তাহারা সামাজিক রীতিনীতিসমূহকে ধর্মীয় সুরে বদলাইয়া দিল । শ্রাদ্ধের নাম দিল চল্লিশা, ঠাকুরের কির্তনের নাম দিল ওয়াজ মাহফিল, বিবাহের সময় পণের নাম দিল যৌতুক, অন্নপ্রাশনের নাম দিল মুখে ভাত ইত্যাদি ইত্যাদি । সামাজিক রীতিনীতিও থাকিল, ধর্মও থাকিল ! কি চমৎকার !
যাহার উপরের লাইন দু-খানি পড়িয়া ফোঁস ফোঁস করিতেছেন, করজোরে নিবেদন করি একটু কোরআন-সুন্নাহ আর আরব মুলুক ঘাটিয়া দেখুন উপরের এই তিন-চারখানা আচারের একখানাও কোথাও পান কি না । পাইলে কমেন্টে বলিবেন ।
যাহা হোক । সমস্যা হইল যে সকল সামাজিকতা-রীতিনীতি-আনন্দ-উৎসব বদলাইয়া ফেলা গেল না । যাওয়া সম্ভবও না ।
তাই সকল কজনফিউশনও দূর হইল না ।
ধর্মের ভেতর দ্বিধা না থাকিলেও, হাজার বছরে অভ্যাসের দরুণ মনের ভিতরে দ্বিধা ঢুকিল । কোনটা পালন করিব, আর কোনটা ছাড়িব ?
নিজের পরিচয় লইয়া বিস্তর দ্বিধার সূত্রপাত হইল । আমরা কি ? বাঙ্গালী না কি মুসলমান ? কোনটা ধরিব আর কোনটা ছাড়িব ?
কি এক্টা অবস্থা !
এর ভেতর ঘটিল আরেক ঘটনা ।
ভারত দখল করিল মোঙ্গলগণ, যাহারা আসিলো মূলত: উজবেকিস্তান হইতে । ভারতীয়দের মত ইহারাও নব্য মুসলমান । শামান ধর্ম ছাড়িয়া তাহারা মাত্র দুইশ বৎসর আগে হইতে মুসলিম হওয়া শুরু করিয়াছে । ধর্মীয় বিষয়াদিতে মনে মনে ইহারা এখনও অনেক উদার । ভারত দখল করিয়া ইহারা ধর্ম চাপাইয়া দিল না । বরং ভারতের আদি সনাতন ধর্মও অনেকখানি মানিয়া লইল । হিন্দু-মুসলিমে বিবাহ পর্যন্ত হইল । ইহারা মসজিদও বানায়, আবার মন্দিরও বানায় । কোপ্তা-কাবাবও খায়, আবার নিরামিশও খায় ।
এইবার বাঙ্গালীর ভিতরে কনফিউশন আরও বাড়িল । মুসলমান হইলে এইগুলি করা যায় ? না কি যায় না ? আমরা কি ? বাঙ্গালী না কি মুসলমান ? কোনটা ধরিব আর কোনটা ছাড়িব ? কি করিব আর কি না করিব ?
কি এক্টা অবস্থা !
এই কনফিউশন লইয়া আরও তিনশ বৎস কাটিল ।
সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার হইতে আসিল সাদা চামড়ার ইউরোপীয়ানগণ, এবং সাথে আসিল তাহাদের ধর্ম ‘ঈসায়ী’ বা ‘খ্রীস্টান’ ।
রাজার ধর্ম মানিয়া এইবার বাঙ্গালী আবারও এক পা আগাইয়া আসিল ।
লুংগী-ধুতি খুলিয়া প্যান্টুলুন পরিল । কাফতান-ফতুয়া খুলিয়া শার্ট-কোর্ট গায়ে চড়াইল, শাড়িতে ব্লাউজ জুড়িল । জন্মদিন, আনন্দ প্যারেড ইত্যাদি উৎসব গ্রহণ করিল ।
এর মধ্যে আসিল পুঁজিবাদ । ‘টাকা’ হইয়া গেল নতুন ঈশ্বর । হাতে টাকা থাকিলে আর কিছু লাগে না । জাত, পাত, ধর্ম, বর্ণ সবই তুচ্ছ ! সুতরাং, বাঙ্গালীর টাকা বানাইতেই হইবে । চুরি, জোচ্চুরী, লোক ঠকানো, দূর্নীতি, সূদ যে করিয়াই হোক না কেন ।
এইভাবে চলিল দুইশ বৎসর ।
এবং ফলাফল স্বরুপ বাঙ্গালী ধর্ম এবং সংষ্কৃতি দুই লইয়াই আরও কনফিউজড হইয়া গেল !
এই গরম আর তীব্র আদ্রতার দেশে আরামের লুংগি-ফতুয়া পরিলে দেহমনে শান্তি হয়, কিন্তু ইউরোপের স্যুট-কোট না পরিলে তো মান থাকে না, আবার মধ্যপ্রাচ্যের কুর্তা-পায়জামা কিংবা তাহার ভারতীয় সংষ্করণ পান্জাবী না পরিলে নিজেকে ঠিক ধার্মিক ঠাহর হয় না ।
এখন বাঙ্গালীর মনে আলপনা-আঁকা উৎসবও পালন করিতেও ইচ্ছা জাগে (শত হইলেও পাঁচ হাজার বৎসরের অভ্যাস), আবার থার্টিফাস্ট আসিলে গ্লাসে টুংটাং করিতেও মন চায়, ইদানিং হ্যালুইন আসিলে মুখে মুখোস চড়াইতেও শখ জাগে, আবার চুরি-জোচ্চুরী-ঠগবাজী-সূদ যে করিয়াই হোক টাকা না বানাইলে সমাজে মুখ থাকে না, আবার দিন শেষে বেহেশতে যাইতেও হইবে ।
না পারে এদিকে ছাড়িতে, না পারে ওদিকে ধরিতে !
কি এক্টা অবস্থা !
সুতরাং, যখনই কোন উপলক্ষ্য আসে বাঙ্গালী কনফিউজড হইয়া যায় । কনফিউজড হইয়া প্রথমে দুই দলে ভাগ হয় । তাহার পর তর্ক-বির্তক-গালাগালি-লাঠালাঠি জুড়িয়া দেয় । একদল বলে ইহা করিলে ঐতিহ্য থাকিবে । আরেকদল বলে করিলে ধর্ম থাকিবে না । একদল বলে “তোর জাতি-পরিচয় নাই ।” আরেকদল বলে “তোর ধর্ম নাই ।” ধর্ম-ওয়ালা হউক কিংবা জাতি-ওয়ালা – আদতে উগ্রতা-গালাগালি-লাঠালাঠির বিচারে দুই দলই সমানে সমান । কেহ কারো চাইতে বিন্দুখানিও কম যায় না । একদল লাঠাইয়া ঐতিহ্য রক্ষা করিতে চায়, আরেকদল প্যাদাইয়া ধর্ম রক্ষার ব্রত ধরে । দুই দলই আসলে মনে মনে ভীষন কনফিউজড ! কোনটা ঐতিহ্য আর কোনটা ধর্মীয় তাহাও বোঝে না, কোনটা বাছিবে আর কোনটা রাখিবে তাহাও ঠাহর করিয়া উঠিতে পারে না । মাঝখান হইতে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের প্রতিটা উৎসব এখন তর্কের উপলক্ষ্যে পরিণত হইয়া গেছে । ধর্মীয় হউক কিংবা সামাজিক, নতুন হউক কিংবা পুরাতন – উৎসব মানেই এখন চায়ের দোকান ছাড়াইয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র বাদানুবাদ-গালাগালি আর ট্রলের জোয়ার । চৈত্র সংক্রান্তি, নতুন বৎসর, নবান্ন, ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, আশুরা, পুজা, বড়দিন কোনোটিকেই আমরা ছাড়ি নাই । এমনকি এই বঙ্গে ঈদও পালন হয় দুই দিনে – আরবের চাঁদ ধরিয়া, দেশীয় চাঁদ ধরিয়া ।
কি এক্টা অবস্থা !
যাহা হউক । শেষ করি একখানা নিরীহ গল্প দিয়া ।
গেল মাসে ভারতে মোঘলশাহী’র ঐতিহ্য দেখিতে গিয়াছিলাম । সম্রাট আকবরের কবর কমপ্লেক্সে গিয়া দেখিলাম এই বঙ্গ হইতে যাওয়া এক ব্যক্তি কবর কমপ্লেক্সের দেয়ালের কতক জায়গায় ভীষণ ভক্তিভরিয়া বার বার চুমু খাইতেছে । দেখিয়া অদ্ভুত লাগিল !
থাকিতে না পারিয়া শুধাইলাম “ও মশায়, এই দেয়ালে এইরুপে চুমু খাইতেছেন কেন ?”
মহাশয় বলিলেন “দেখেন না, দেয়ালের গায়ে কি সুন্দর আরবীতে পবিত্র কোরআনের আয়াত লেখা । চুমু খাইব না কেন !” তারপর তিনি একটু উষ্মাভাবেই আমাকে বলিলেন “গলায় তো সৌদির ‘কাফিয়া’ পরা, তারমানে আপনি মুসলমান । আর এই সামান্য জিনিষ বুঝলেন না ! তা কেমনতর মুসলমান আপনি !”
আমি হাসিয়া বলিলাম “মহাশয় যেই লিপিকে আপনি আরবি ভাবিয়া আবেগিত হইতেছেন তাহা আরবি নহে বরং ফার্সি ভাষা । আর যাহাকে আপনি পবিত্র কোরআন ভাবিয়া পরম ভক্তি ভরিয়া চুমু খাইতেছেন, তাহা পবিত্র কোরআনের আয়াত নহে বরং একখানি ফার্সি কবিতা মাত্র !”
কি এক্টা অবস্থা !
This artcile was reprinted from a personal groupmail. We found it to be intersting and therfore, decided to share with our readers. No permission for re-print was obtained. I am sure, the original writer will not have any objection. If any objection is recieved, we will gladly retract this artcile.
Management TBC
                








