কালো টাকা সাদা করার নতুন পদ্ধতি বলে সন্দেহ এনবিআরের

রফতানিতে প্রণোদনা পেতে হলে বিদেশ থেকে মূল্য প্রত্যাবাসনের ১৮০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করতে হয়। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্মের মাধ্যমে নিরীক্ষা করানোর নিয়ম রয়েছে। এ নিরীক্ষা শেষে দেয়া সনদের ভিত্তিতে রফতানিকারককে ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ সহায়তার অর্থ বিতরণ করা হয়। যদিও এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই নগদ প্রণোদনা নেয়ার নজির রয়েছে অনেক। এমনকি পণ্য রফতানি না করেও নগদ প্রণোদনা নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সাম্প্রতিক এমন কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর সন্দেহ করছে, এভাবে রফতানি না করে মিথ্যা ঘোষণায় অর্থ প্রত্যাবাসন এবং নগদ প্রণোদনা গ্রহণের পাশাপাশি কালো টাকাও সাদা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি জিলানি এক্সিম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ৭৩টি বিল অব এক্সপোর্ট যাচাই করতে গিয়ে এ সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। এসব বিলে আলু রফতানির ঘোষণা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটি তা রফতানি করেনি। যদিও এ রফতানির বিপরীতে ব্যাংক থেকে নগদ প্রণোদনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া অন্যান্য প্রক্রিয়াও ছিল ভুয়া। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটির রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত তথ্য চাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এনবিআরের রফতানি, বন্ড ও আইটি বিভাগে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ।

এনবিআরের অভ্যন্তরীণ এক চিঠি সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কমিটির অনুসন্ধানে উঠে আসে, ওই প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০টি বিল অব এক্সপোর্টের মধ্যে ২৭টির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা নিয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ১৩ ডলার। উত্তরা ব্যাংকের মাধ্যমে ৪৩টি বিল অব এক্সপোর্টের মধ্যে ৩৯টির বিপরীতে নিয়েছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪৫ ডলার। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মোট নগদ প্রণোদনা নিয়েছে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৫৯ ডলারের সমপরিমাণ, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ কোটি ৮ লাখ টাকার বেশি। এজন্য এনবিআরের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম ও ব্যাংকে বিল অব এক্সপোর্ট বা শিপিং বিলগুলো জমা দেয়া হয় ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, শুধু নগদ প্রণোদনাই যদি ৭ কোটি টাকার বেশি হয়, তাহলে ভুয়া রফতানির মাধ্যমে প্রত্যাবাসিত বা সাদা করা কালো টাকার পরিমাণ আরো অন্তত ১০ গুণ বেশি। কারণ গত এক দশকে আলু রফতানিতে দেয়া নগদ প্রণোদনার হার ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। ভালোমতো অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে, শুধু জিলানি এক্সিম নয়; এমন আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এ ধরনের কার্যক্রম কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একা করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে দেশের বাণিজ্য খাতে এ ধরনের কোনো চক্র সক্রিয় আছে কিনা বা থাকলেও কতগুলো সে বিষয়ে ভালোমতো অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে জিলানি এক্সিমের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে এনবিআরে দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ডিপো রফতানির জন্য পণ্য নেয়নি বা বিদেশে পাঠায়নি। রফতানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট পারস্পরিক যোগসাজশে এ ধরনের জালিয়াতি করেছে। তারা সংশ্লিষ্ট দলিল তৈরি করে রফতানির বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা করেছে। এজন্য রফতানিকারক ও সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বন্দর থানায় ফৌজদারি মামলা (নম্বর-১৬) করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ।

বিষয়টি নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জিলানি এক্সিম ও সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। তবে কাস্টম হাউজের কেউ এর সঙ্গে জড়িত কিনা তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা সে বিষয়েও চিঠিতে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর সঙ্গে রফতানি পণ্য পরিবহন থেকে ব্যাংক পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়ায় নানা ধাপের অনেকেই জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যথাযথভাবে অনুসন্ধান চালালে প্রকৃত বিষয়টি উন্মোচন হবে।

এ বিষয়ে কাস্টমস বিভাগের একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করা হয়েছিল। এখন আবার কাস্টম হাউজের অনুসন্ধানেই উঠে এসেছে পণ্যগুলো রফতানি হয়নি। তার মানে ঘটনাটি শুল্ক ফাঁকির নয়। এজন্য বিষয়টি নিয়ে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। নগদ প্রণোদনা নেয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্ট, সেটি তারা দেখবেন।’

শুধু জিলানি এক্সিম নয়, দেশের আর্থিক খাতের এমন বেশ কয়েকটি আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটনায় রফতানি আয়ের প্রণোদনার ক্ষেত্রেও অনিয়মের ঘটনা দেখা গেছে। এক্ষেত্রে নিরীক্ষকের জাল সনদের মাধ্যমে প্রণোদনার অর্থ তছরুপের নজিরও রয়েছে।

প্রক্রিয়াটিকে কালো টাকা সাদা করার পদ্ধতি হিসেবে সন্দেহ করছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। দেশের রাজস্ব সংগ্রহে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানটির অন্তত চারজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেছেন, বিষয়টি মানি লন্ডারিং আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধ। অতীতে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে রফতানি প্রণোদনার অর্থ গ্রহণের অনেক নজির পাওয়া গেছে।

এর আগে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের পক্ষ থেকে গত বছর রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা কার্যক্রমের ওপর একটি কমপ্লায়েন্স অডিট পরিচালনা করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা নগদ প্রণোদনা কার্যক্রম যাচাই করে সংস্থাটি। এতে নিরীক্ষার ভিত্তিতে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে।

এতে দেখা গেছে, বেশকিছু রফতানিকারক রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসন হওয়ার ১৮০ দিন পরও নগদ প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছেন। এর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রণোদনার অর্থ বিতরণও করেছে। যদিও নিয়মানুযায়ী এক্ষেত্রে রফতানিকারকের প্রণোদনা পাওয়ার কথা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসনের ৩৭৯ দিন পরও প্রণোদনার জন্য আবেদনের নজির রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে রফতানির তথ্য জালিয়াতি বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। রফতানি আয়ের পরিসংখ্যান থেকে শুরু করে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য (বিওপি), চলতি হিসাব, জিডিপিসহ নানা খাতে তা প্রভাব ফেলে।

সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে যথাযথ সংযোগ গড়ে তোলা যায়নি বলেই এর আড়ালে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন এনবিআরের সাবেক সদস্য (শুল্ক ও ভ্যাট) ফরিদ উদ্দিন। এনবিআর সংস্কার কমিটির এ সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিপিং কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক যদি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের সঙ্গে সত্যিকার অর্থেই সংযুক্ত থাকত, তাহলে এ ঘটনা ঘটত না। কাস্টম হাউজ কবে অ্যাসেসমেন্ট করেছে, জাহাজে কবে পণ্য উঠেছে সে তথ্য অ্যাসাইকুডা যাচাই করতে পারত। শিপিং কোম্পানির বিল অব লেডিং (বিএল) ছাড়া ব্যাংক প্রণোদনা দিল কীভাবে? আর যদি বিএল দিয়েও থাকে, তার মানে শিপিং কোম্পানি ভুয়া কাগজপত্র দিয়েছে!’

সিএজির অডিটে নগদ প্রণোদনায় যেসব অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শতভাগ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান না হওয়া সত্ত্বেও নগদ প্রণোদনা গ্রহণ, আবেদনের নির্ধারিত সময়সীমা অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রণোদনা নেয়া, এলসির মাধ্যমে আমদানি করা সুতার মূল্য বাদ না দিয়ে নগদ সহায়তা গ্রহণ, এলসির মাধ্যমে কেনা সুতা রফতানি হওয়া তৈরি পোশাকে ব্যবহার না করে প্রণোদনা নেয়া, ইএক্সপি ইস্যু, পণ্য জাহাজীকরণ ও রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসনের আগেই আবেদনের বিপরীতে নগদ সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।

এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

Bonik Barta

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here