ঈদ আনন্দ নেই বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর পরিবারে। কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে এবারও ঈদ করতে হচ্ছে দলটির কয়েকশ নেতাকর্মীকে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মামলায় বন্দি তারা। তাদের অনেকে আছেন বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে নাশকতার অভিযোগে বন্দি। আবার সাজাপ্রাপ্ত মামলায় জামিনের আশায় আত্মসমর্পণ করে কারারুদ্ধ হন অনেকে। কেউ কেউ বিভিন্ন মামলায় আগাম জামিন শেষে হাজিরা দিতে গিয়ে গেছেন কারাগারে। এমনকি সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বছরের পর বছর ধরে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রয়েছেন অনেকেই। কবে তাদের মুক্তি মিলবে– তা কেউ জানেন না। পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ আবার কবে ভাগাভাগি করতে পারবেন, তাও বলতে পারেন না তারা। এ পরিস্থিতিতে ম্লান হয়ে গেছে তাদের স্বজনের ঈদ আনন্দও।
বিএনপি সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর রাজপথে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি শুরু করে দলটি। আর এ কর্মসূচি ঘিরে সারাদেশে চলে গণহারে গ্রেপ্তার অভিযান। বিএনপির দাবি– ওই সময় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ প্রায় ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে বন্দি করা হয়। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বেশির ভাগের জামিনে মুক্তিও মিলেছে। তবে এখনও শতাধিক নেতাকর্মী রয়ে গেছেন কারাগারে। এসব নেতাকর্মী ছাড়াও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একদিকে যেমন সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশ উত্তাল হয়ে পড়ে, তেমনি শুরু হয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুরোনো মামলার সাজার রায়। প্রায় একশ মামলায় দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে সাজা দেন আদালত। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও রয়েছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, অন্দোলন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর একটি অংশ আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেছেন। আবার আন্দোলনকালীন বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর পুরোনো মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ায় তারাও গেছেন হাজিরা দিতে। এসব নেতাকর্মীর বেশির ভাগকেই পাঠানো হয়েছে কারাগারে।
জানা গেছে, সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, স্বেচ্ছাসেবক দলের দপ্তর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি মোস্তফা কামাল হৃদয়, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এ খোকন, উত্তরা থানার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেনসহ অনেকে আত্মসমর্পণ করেন।
এ ছাড়া বিগত দিনের মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে কারাগারে গেছেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, জেলা বিএনপির সদস্য মুনির আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, জেলা যুবদল সভাপতি এম তমাল আহমেদ, জেলা ছাত্রদল সভাপতি রাজিউর রহমান সাগর, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বাপ্পিসহ ৫১ জন, দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিনাজপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান মিয়া, চিরিরবন্দর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরে আলম সিদ্দিকী নয়ন, সাভার উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাভার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিনসহ অনেকে।
এ ছাড়া বছরের পর বছর ধরে কারাগারে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অব্দুস সালাম পিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, নির্বাহী সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন অপু।
এসব নেতার বাইরে কারাগারে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আজিজুর রহমান মুসাব্বির, ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবির, ঢাকা কলেজ ছাত্রদল নেতা জামাল হোসেনসহ অনেকে।
ইখতিয়ার রহমান কবিরের স্ত্রী জুঁই জানান, তাঁর দুই বছরের ছেলে আয়াছ বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য প্রায় রাতে ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। গ্রেপ্তারের আগে বাবাকে ছাড়া সে একদিনও থাকেনি। মনে করেছিলাম অন্তত ঈদের আগে ইখতিয়ার কবির জামিনে মুক্তি পাবেন। কিন্তু বাবা ছাড়াই ঈদ কাটবে তার সন্তান আয়াছের।
রাজীব আহসানের মা ফরিদা বেগম জানান, তাঁর ছেলে যবে থেকে রাজনীতি করছেন, তবে থেকেই তাদের ঈদহীন চলছে। কোনো সময় কারাগারে, কোনো সময়ে ফেরারি আবার কোনো সময় রাজনৈতিক ব্যস্ততায় পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেনি রাজীব। একমাত্র ছেলেকে কাছে না পেলে, তাঁকে কারাগারে রেখে কোনো মায়ের মনে ঈদ আনন্দ আসে না। যখন ব্যস্ত থাকে কিংবা ফেরারি থাকে, তখন অন্তত সান্ত্বনা থাকে– ছেলে ভালো আছে। কোনো পরিচিতের সঙ্গে ঈদ করছে, নামাজ পড়ছে। অন্তত ফোনে কথা বলত ভাগনে-ভাগনি, বোন, বোন জামাইসহ তাঁর সঙ্গে। এখন তো কেউ ফোনও দেবে না। শুধু রাজনীতির কারণে আজ তাদের এই কষ্ট সইতে হচ্ছে।
হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মেয়ে জান্নাতুল ইলমী সূচনা বলেন, ৪৯০টিরও বেশি মামলায় কেরানীগঞ্জের কারাগারে আছেন বাবা। বছরের ছয় মাস জেল কিংবা ছয় মাস পলাতক থাকেন, ফলে কোনো উৎসব আয়োজনে বাবাকে পাওয়া যায় না। সন্তান হিসেবে বাবার দেখা মেলে না।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন অপুকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে আজানের বয়স এখন ছয় বছর। জন্মের পর থেকে বাবার সঙ্গে তার ঈদ করা হয়নি। বাবার হাত ধরে ঈদগাহে যেতে পারেনি। ঈদের দিন ছাড়াও অন্যান্য দিনে বাবার ছবির দিকে শিশু ‘আজান’ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বলে জানান পরিবারের অন্যান্য স্বজন।
৮ বছর ধরে কারাগারে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। ২০১৬ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর থেকে শুরু হয় একের পর এক পেন্ডিং মামলা। একটিতে জামিন হলে আরেকটি সামনে আসে। এভাবে তাঁর কারাজীবন দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবারের।
আসলামের ঘনিষ্ঠ যুবদল নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, তাঁকে বছরের পর বছর কারাগারে আটক রাখায় ধ্বংস হয়ে গেছে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা। অন্যদিকে কষ্টে আছেন পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের সদস্যরা জানান, বিগত ৮ বছর ধরে তাদের মধ্যে কোনো ঈদ আনন্দ দূরে থাক, কোনো উৎসব নেই।
samakal