কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির বাংলাদেশ সফরটি সংক্ষিপ্ত হলেও নিশ্চিতভাবে তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সফরকালে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। সেই আলোচনায় ঢাকা-দোহা সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তারা। বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানির সফরের ১৯ বছর পর ঢাকায় এসে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন আমীর শেখ তামিম। ঢাকা আর কক্সবাজারে বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ, মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো যোগাযোগ-অবকাঠামোর কারণে বদলে যাওয়া নতুন এক বাংলাদেশকে নিজ চোখে দেখেন তিনি। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের ভাষ্য মতে, শীর্ষ বৈঠকে উচ্ছ্বসিত কাতারের আমীর বারবার সেটাই বলছিলেন। তখন ‘সিং ইজ বিলিভিং’ প্রবাদটি স্মরণ করছিলেন অনেকে। সচিব জানান, সংযুক্তি, পর্যটনসহ নানা খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজতে কাতারের আমীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তিনি দেশে ফিরে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়ার কথাও জানিয়ে গেছেন। জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তিনি।
কাতারের আমীরের সফরে কী পেতে পারে বাংলাদেশ- এ নিয়ে আগাম রিপোর্ট করেছিল জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে। তাদের রিপোর্টে প্রত্যাশার প্রাক্কলন ছিল। বলা হয়েছিল- সফরটি ব্যবসা-বাণিজ্য, জনশক্তি রপ্তানি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই রিপোর্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের বক্তব্যের উল্লেখ ছিল। মন্ত্রীর ভাষ্য ছিল এমন ‘আমাদের দেশে এনার্জির মজুত আরও বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবং এনার্জি সিকিউরিটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’ ডয়চে ভেলের রিপোর্টে বলা হয়- বাংলাদেশ এক বছরের বিলম্বিত পেমেন্টে কাতার থেকে জ্বালানি কিনতে চায়। বাংলাদেশ এলএনজির জন্য বলতে গেলে পুরোপুরি কাতারের ওপর নির্ভরশীল। সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হককে উদ্ধৃত করে সেই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ যদি এখন লং টার্ম পারচেজ এগ্রিমেন্টে যেতে পারে তাহলেই সস্তা দামে এলএনজি পাবে। এতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। স্পট মার্কেট থেকে কেনার কারণে এখন দাম বেশি পড়ছে জানিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের পাওয়ার প্লান্টগুলোর একটি অংশ এখন এলএনজিতেই চলছে। তাই এর সাপ্লাই নিশ্চিত হলে বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও ভালো অবস্থা তৈরি হবে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেনও মনে করেন এলএনজি আমদানি ছাড়াও কাতারে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য দোহার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন জরুরি। তাছাড়া কাতার থেকে বিলম্বিত পেমেন্টে এলএনজি আনার চেষ্টার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তবে এটি যে পাওয়া কঠিন হবে তা বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপে আগাম বলে রেখেছিলেন পোড় খাওয়া ওই কূটনীতিক। তিনি এ-ও বলেছিলেন কাতারে অন্য দেশের কর্মীদের চেয়ে বাংলাদেশিরা কম মজুরি পান। এর কারণ হলো তারা কোনো ব্যক্তির অধীনে ওই দেশে যান। নিয়োগকর্তা তাদের আয়ের একটি অংশ রেখে দেন। তার পরামর্শ ছিল উপযুক্ত মজুরিপ্রাপ্তির বিষয়টি উত্থাপনের। যাতে আমাদের শ্রমিকেরা না ঠকেন। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরীও কাতারে জনশক্তি পাঠানো সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন এবং শ্রমিকদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনায় তোলার অনুরোধ করেছিলেন। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো কাতারের আমীরের সফরে বাংলাদেশ কীভাবে, কতোটা উত্থাপন করতে পেরেছে? তা জানতে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এর অনেক কিছুই যে আলোচনায় এসেছে সেই দাবি করছেন সফরসংশ্লিষ্টরা।
আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি সোমবার বিকাল ৫টা থেকে মঙ্গলবার ৩টা অবধি বাংলাদেশে মাটিতে ছিলেন। সফরের প্রথম দিনে তিনি কোনো কর্মসূচি রাখেননি। ওইদিন একান্ত নিজের মতো করে সময় কাটিয়েছেন রাজধানীর তারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানে। সূত্র বলছে দীর্ঘ ভ্রমণে রুটিনে তেমন পরিবর্তন আনেননি আমীরের। ঢাকায় পৌঁছানোর পরপরই তিনি জিমে গেছেন। মঙ্গলবার প্রাতঃরাশের আগেও তিনি ব্যামাগারে কাটিয়েছেন কিছুক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করতে তার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে যান। সেখানে প্রথমে একান্তে ২৫ মিনিটের মতো এবং পরে ৪৫ মিনিটের আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেন তারা। দুই শীর্ষ নেতার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরপর কাতারের আমীর বঙ্গভবনে তার সম্মানে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন প্রদেয় মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। বঙ্গভবন থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেস দিয়ে তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সরকার প্রধানের সঙ্গে আমীরের একান্ত বৈঠকে কোন কোন বিষয় আলোচনা হয়েছে তা এখনো অপ্রকাশিত। তবে আলোচনার অনেক কিছুই পরবর্তীতে দুই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে হয়তো স্পষ্ট হবে। দু’পক্ষের প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যকার যে আলোচনা হয়েছে তা ছিল অনেকটা প্রাণবন্ত। সেই আলোচনার পুরোটা সময় উভয় শীর্ষ নেতার মুখে হাসি ছিল। এমনকি প্রকান্ত বৈঠক থেকেও তারা খোশ মেজাজেই বেরিয়ে আসেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন- ঢাকার আলোচনার পথ ধরে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ও দোহার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। বৈঠক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যকার বাণিজ্য যে সম্প্রতি আড়াইশ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, তাতে প্রাধান্য এলএনজির। বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার কাতার মনে করছে, এ দেশে যে ধারায় উন্নয়ন এগিয়ে চলছে, এলএনজির চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে জ্বালানির পাশাপাশি অন্য কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুযোগ আছে, সেটা যাচাই করা জরুরি। কাতার এখন যে এলএনজি বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করে, সেগুলো জাহাজে করে বন্দরে বহির্নোঙরে এনে সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এলএনজি সরবরাহের জন্য তাদের টার্মিনাল তৈরির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কাতারও এলএনজি সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রসঙ্গত, কাতার থেকে প্রতি বছর ১৫ লাখ টন এলএনজি আমদানির জন্য গত জানুয়ারিতে পেট্রোবাংলা ও কাতার গ্যাসের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে চুক্তিটি কার্যকর হবে। কাতারের আমীর বাংলাদেশের সঙ্গে পর্যটন খাতে সহযোগিতার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে বিনিয়োগের জন্য কাতারের আমীরকে অনুরোধ জানান। এ ছাড়া দেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারকে বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে ঢাকা, যা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন কাতারের আমীর। ঢাকার বৈঠকে ইরান-ইসরাইল সংঘাতসহ মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার প্রধান ও কাতারের আমীর উভয়েই মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তে থাকা অস্থিরতা ও সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি দক্ষ শ্রমিক পেতে আগ্রহ দেখিয়েছে কাতার। তবে অল্প দক্ষ শ্রমিকদের বিষয়টিও যেন দেখভাল করা হয়, সেই অনুরোধ করেছে ঢাকা।
manabzamin