রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরে্ন্টে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে
রাজধানী ঢাকা এখন এক নিয়ন্ত্রণহীন শহর। বিশেষ করে, ভবন নির্মাণ ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যেন কোনো আইন-কানুনের তোয়াক্কা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ ও অনৈতিক উপায়ে সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করা যায় বলেই এসব ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। সম্প্রতি বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর এটিই যেন প্রমাণিত হয়েছে।
রাজধানীজুড়ে ছাদসহ একই ভবনে একাধিক হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠার পেছনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি কর্পোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। ওই দুর্ঘটনার পর রাজধানীজুড়ে অবৈধ হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন।
তবে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে অভিযান পরিচালনার আইনগত বাধ্যবাধকতা রাজউকের হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় তারাও কাজ করছে।
সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বাংলা আউটলুককে বলেন, বেইলি রোডে ভষ্মীভূত হওয়া আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের মালিকানাধীন গ্রিন কোজি রিসোর্টটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক। রাজউকের দাবি, তারা ভবন কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে সতর্ক করেছে। তবে এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মাঠ কর্মকর্তারা অনেক সময় দায়সারা কাজ করেন। তারা এসব ভবনে ব্যবসা চালিয়ে যেতে ভেতরে ভেতরে সহযোগিতা করেন। কেন-না সেখান থেকে তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটার আগে সেটি আমাদেরও তেমন জানা থাকে না।
ওই কর্মকর্তার মতে, রাজউকের গাফিলতির বিষয়টি মাথায় রেখেই এ কাজে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এগিয়ে এসেছে। তারা জনস্বার্থে এসব অবৈধ ভবন, হোটেল-রেস্তোঁরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এদিকে সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় সোমবার ধানমন্ডির কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজা সিলগালা এবং কেয়ারি ক্রিসেন্ট ও রূপায়ণ জেডআর প্লাজার ৪ প্রতিষ্ঠানকে ৬ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
দক্ষিণ সিটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনাকালে সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট বন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে থাকা ভিসা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নামক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা থাকায় পুরো ভবনটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
এছাড়া পার্শ্ববর্তী রূপায়ণ জেডআর প্লাজায় অভিযানকালে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতি পাওয়ায় দ্য বুফে এম্পায়ার, বাফেট লাউঞ্জ ও বাফেট প্যারাডাইজ নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেককে ১ লক্ষ টাকা করে মোট ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। মঙ্গলবারও এ অভিযান চালানো হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের আওতাধীন এলাকার ভবনগুলোর ওপর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আরবান রেজিলিয়ান্স প্রকল্পের আওতায় ভূমিকম্পে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত ৪২টি সরকারি ভবন ভাঙতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ১২ মার্চের ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তিন মাসের মধ্যে এসব ভবন না ভাঙলে রাজউক নিজ উদ্যোগে ভাঙবে। এরই মধ্যে প্রায় ১ বছর পার হয়ে গেলেও ঝুঁকিপূর্ণ একটি ভবনও ভাঙা হয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় গত বছরের ১২ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ভবন ভাঙার সুপারিশ করেছিল রাজউক। এই প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ভবন, অর্থনীতি বিভাগ ভবন, কলা ভবনের দুটি অংশ। এই ভবনগুলোতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করেন। মাঝে মধ্যে এসব ভবনের ক্লাসরুমের ওপরের ছাদ থেকে পলেস্তারা ও ইট খসে পড়ে। বিশেষ করে কলা ভবনের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায়ই ছাদ থেকে পলেস্তারাসহ ইট খুলে পড়ছে।
একইভাবে রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) যে ভবনটিতে বসেন, সেটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ তলার ডি ব্লকও। বিএসএমএমইউর ‘এ’ -‘বি’ও ‘ডি’ ব্লকের ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে সেগুলো খালি করতে নির্দেশ দেয় রাজউক। মে মাসে চিঠি দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মীর মশাররফ হোসেন হলটিও ভাঙার সুপারিশ করেছিল রাজউক। পাশাপাশি জাবির পুরনো কলা ভবন, নতুন কলা ভবন, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবন এবং জাবি স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবন মজবুতকরণের সুপারিশও করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে একাধিকবার চিঠি দিলেও কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার টেকনোলজি ভবন, মাদরাসা বোর্ডের ভবন এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভবনও ঝুঁকিতে রয়েছে। বারবার সতর্ক করার পরও কোনো সংস্থা কাজ করছে না ফলে রাজউক আবারও চিঠি দেয়। কিন্তু এরপরও টনক নড়ছে না প্রতিষ্ঠান প্রধানদের।
আরবান রেজিলিয়ান্স প্রকল্পের জরিপে এই প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৫২টি ভবনের ওপর কাজ করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ২২৯টি ভবনের ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট (ডিআইএ) করা হয়। তাতে ১৮৭টি ভবনকে রেট্রোফিটিং করার পরামর্শ দেয় রাজউক। সেসব ভবনের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির তিনটি, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চারটি, মাদরাসা বোর্ডের ছয়টি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১০টি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১৫৪টি ভবন রয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকদফা চিঠি দিয়েও কাজ হয়নি। তাই চরম ঝুঁকি নিয়েই কাজ চলছে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিদপ্তরের কাজ।
এ বিষয়ে রাজউকের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সদস্য মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, রাজধানীর কোনো ভবনে কোনো দুর্ঘটনা হলেই এর দোষ পরে রাজউকের ওপর। তার মতে, অবশ্যই রাজউকের দেখভালের দায়িত্ব বেশি। কিন্তু যারা নিরাপত্তার জন্য অন্যান্য ছাড়পত্র দেন, যেমন বিদ্যুৎ ও পানিসহ প্রায় এক ডজন সংস্থা। তাদেরও ওই সকল ভবনে নিরাপত্তার বিকল্প ব্যবস্থা আছে কি না সেগুলো দেখা উচিত। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৪২টি ভবন ভাঙার বিষয়ে বারবার সতর্ক করে চিঠি আদান-প্রদান করার পরও কোনো সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যা খুবই দুঃখজনক।
এদিকে, রবিবার জাতীয় সংসদে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিম জানান, তার সময়কালে নগরীর ১৩০০ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালীদের কারণে সেগুলো ভাঙা বা অপসারণ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মাদ খান বলেন, রাজধানী ঢাকা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি অগোছালো। নিরেট আবাসিক এলাকা বলে এখন আর কিছু নেই। অথচ, একটি মেগাসিটির জন্য সেটি অত্যাবশ্যক।
অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো বছরের পর বছর অবৈধপন্থা অবলম্বন করেই টিকে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। কোনো একটি দুর্ঘটনার পর কিছুদিন হাঁকডাক দিয়ে কিছু অভিযান হয়তো হবে, কিন্তু এর স্থায়ী সমাধান হবে না।
Bangla outlook