কল্পনা, ভূগোল ও ভারত

কল্পনা, ভূগোল ও ভারত

Image result for Hindu geography of India and plan

ফরহাদ মজহার     13 December 2019

১. কল্পনা, ভূগোল ও ভারত
………………………..

কল্পনাকে আমরা অবাস্তব ও হাল্কা ব্যাপার গণ্য করি। আসলে সেটা ঠিক না। কল্পনার শক্তি অসামান্য। এই নিয়ে কয়েক কিস্তি লিখার বাসনা হয়েছে।

ধরেন ‘বাংলাদেশ’ নামক কল্পনা। এই কল্পনা কবে থেকে শুরু হয়েছে? বেশীদিন কি? কিন্ত এখন আমরা সেই কল্পনার মধ্যে বাস্তবে বাস করি। যা একদা ছিল কল্পনা তা এখন বাস্তবের ভূগোল, দেশ ও রাষ্ট্র। বাংলাদেশ এখন আর কল্পনা না। আগে কল্পনা ছিল এখন বাস্তব।

কল্পনায় আর বাস্তবে তাহলে ফারাক কি? ভাববেন না, দার্শনিকরাই শুধু এইসব নিয়া ক্যাচাল করে। আপনি কল্পনার জগতে বাস করেন না, কল্পনা আর বাস্তব নিয়া আপনার মাথাব্যথা নাই।

কেন নাই? কারণ যে মাথা দিয়ে আপনি কল্পনা করেন সেই মস্তক আপনি আগেই কেটে ফেলে দিয়েছেন। নতুন ভাবে কল্পনা করতে ভয় পান। দৃশ্যমান বাস্তবকে চিরন্তন গণ্য করে নিরাপদ থাকতে চান। ঝামেলায় যেতে চান না, বাঁচতে চান। তাই এখন বাস্তবের বাংলাদেশকে চিরন্তন গণ্য করে বাস করেন। বাস্তবকেই চিরসত্য জ্ঞান করেন।

ঠিক আছে। কল্পনা আর বাস্তবের অতিশয় বাস্তবিক সম্পর্ক এখন বুঝতে পারছেন না। না পারলেও আপনিও আদতে কল্পনার ক্যাচালের মধ্যেই আছেন। বাংলাদেশ নামক বাস্তবতা কল্পনারই বাস্তবায়ন। কল্পনা যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি কল্পনা দিয়ে তৈরি যে বাস্তব সেটাও চিরস্থায়ী নয়। আগে ছিল না, এখন আছে, কিন্তু আগামিতে থাকবে তার কোন গ্যারান্টি নাই।

শুধু দার্শনিকরা ক্যাচাল করেন না। আপনি নিজে ক্যাচালের মধ্যেই বাস করেন।

অহো মনুষ্যজীবন, তুমি কতো বিচিত্র!

২. কল্পনা, ভূগোল ও ভারত
………………………………

কিম্বা ধরেন ভারত। ভারত বলে ভূভারতে কিছু ছিল কি?

‘হিন্দু’, ‘হিন্দুস্তান’ কিম্বা ইউরোপীয়দের ‘ইন্ডিয়া’ ছিল। ভারত নামে এখন যে ভূগোল ও রাষ্ট্র বুঝি এই প্রকার কোন ভূত ভূভারতে কেন দুনিয়ার কোত্থাও ছিল না। ‘হিন্দুস্তান’ ছিল মুঘল সাম্রাজ্য। ‘ইন্ডিয়া’ নামে যেটা ছিল সেটা ছিল ইংরেজদের কলোনি। উপনিবেশ। ভারত বলে কিছুই ছিল না।

তাহলে ভারত নিয়ে কল্পনা কিভাবে শুরু হোল? কিভাবে সেটা বাস্তবের ভারত হোল? কাশ্মির, আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিম বাংলার সাম্প্রতিক অবস্থা দেখে মানুষের ‘কল্পনা’ এবং কল্পনার শক্তি নিয়ে ভাবছি। আমরা বিচিত্র সব মানুষ উপমহাদেশে কে কিভাবে কল্পনা করেছি ও করি তার দ্বারা আমাদের ভবিষ্যৎ আগাম নির্ধারত হয়ে যায়।

তাহলে উপমহাদেশে আমরা কি সকলকে নিয়ে নতুন কোন কল্পনা করতে পারি? নতুন কোন কল্পনা কি আদৌ সম্ভব? আমরা কি এখন আদৌ কল্পনা করতে সক্ষম? দক্ষিন এশিয়াকে কি নতুন ভাবে গড়বার স্বপ্ন দেখব আমরা? নাকি পরস্পরের সঙ্গে মারামারি হানাহানি দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে শেষ হয়ে যাব?

কল্পনা নিয়ে চিন্তার গোড়ায় এই জিজ্ঞাসাটি জেগে আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে গেলে কল্পনার কাছে হাত পাততে হবে। যুক্তিবাদীরা ঘটনা ঘটে গেলে যুক্তি দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করে। হয়তো আগামিতে ব্যাখ্যা করতে বসবে ভারত ভেঙ্গে খান খান হোল কেন? এখন যেমন দেশভাগ নিয়ে বিস্তর থিসিস বেরোয়। ঘটানা ঘটে গেলে ঘটনা বোঝার জন্য যুক্তিবুদ্ধির ভূমিকা আছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে যুক্তির ভূমিকা গৌণ। সেই জগতের ঈশ্বরী হচ্ছেন কল্পনা। কল্পনার ভূমিকা স্রেফ ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ নয়। স্বপ্ন দেখানো এবং দেখতে পারার ক্ষমতার ও সাহস জোগানো তার কাজ। তলে তলে কল্পনা ইতিহাসের নতুন কর্তাদের পয়দা করতে থাকে। একদিন হথাৎ আমরা দেখি তারা কল্পনা বাস্তবায়নে লেগে পরেছেন।

স্বপ্ন দেখা ভাল। ফ্রয়েড বলেছিলেন আমরা সেই বিষয় নিয়েই স্বপ্ন দেখি যা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। ‘কল্পনা’ কথাটিকে ফ্রয়েডীয় আলোকে বুঝলে বুঝতে পারেন। ‘ভারত’ একটি কল্পনা মাত্র এই কথাটি প্রচারের গুরুত্বও বুঝবেন। কেবল তখনই নতুন করে কল্পনা করতে উদ্বুদ্ধ হবেন।

৩. কল্পনা, ভূগোল ও ভারত
………………………………

জ্বি, ভারত নিছকই কল্পনা। এর মানে এটা নয় যে বাস্তবে ‘ভারত’ বলে কিচ্ছু নাই। কিন্তু ভারত কল্পনারই ঐতিহাসিক একটি মূহূর্ত। । চিরস্থায়ী কিছু না।

যদি উচ্চবর্ণের বাঙালি বাবু শ্রেণী ‘ভারত’ নামক কল্পনায় আপ্লূত না হোত, ভারত নামে কিছু বাস্তবে হাজির হোত কিনা সন্দেহ। বাঙালিদের বিরুদ্ধে অহমিয়াদের প্রবল গোস্বার ঐতিহাসিক কারন আছে। সেই কারণ তাদের এখনকার সাম্প্রদায়িকতাকে ন্যায্য প্রমাণ করে না। বাঙালি যদি ‘ভারত’ নামক কল্পনাকে আস্কারা দিয়ে মূর্তমান না করত উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হোত। আজ আসামে আগুন জ্বলছে, সেটা হবার সুযোগ থাকত না। হয়তো অহমিয়াদের ‘কল্পনা’ মাফিক আসাম একটি স্বাধীন দেশ হিশাবে বাস্তবে হাজির থাকত। এখনকার মতো দাঙ্গা-হাঙ্গামার দরকার হোত না। কল্পনা অন্যায্য কিছু নয়, অনৈতিহাসিকও নয়। যদি সেটা জনগণের কল্পনা হয়ে ওঠে তাহলে তাকে দাবিয়ে রাখা কঠিন।

উলফা দিল্লীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছে । একাংশ পরাজয় স্বীকার করে দিল্লির সঙ্গে শান্তি আলোচনা করছে। এখন অহমিয়াদের কল্পনা উগ্র জাতিবাদে রূপ নিয়েছে। কিন্তু আপনি যদি ‘বাংলাদেশ’ কল্পনা করতে পারেন, ‘ভারত’ কল্পনা করতে পারেন তাহলে অহমিয়াদের স্বাধীন রাষ্ট্র ‘আসাম’ ‘কল্পনা’ করতে পারবে না কেন? কেন স্বাধীন ‘মণিপুর’, স্বাধীন ‘ত্রিপুরা’, স্বাধীন নাগাল্যান্ড, স্বাধীন ‘অরুণাচল’ স্বাধীন ‘মেঘালয়’ ইত্যাদি কল্পনা করতে পারবেন না? বিশেষত কেন স্বাধীন ‘কাশ্মির’ না? নিজের বেলায় আঁটিশুটি, পরের বেলায় গুলিগুট্টি’ — এই নীতি কেন? আপনার কল্পনায় আপনি ভারত গড়েছেন, সেই কল্পনায় অন্যদের আপনি ‘অপর’ বা ভিন্ন সত্তা বানিয়েছেন। যারা বাধ্য হয়ে নিজেদের ভিন্ন ভাবে কল্পনা করে, নিজেদের যারা ভা্রতীয় সংবিধানে অধীন গণ্য করে না, তখন তাদের গুলি মারেন কেন? আপনার কল্পনা পাহারা দেবার জন্য সেনা মোতায়েন করতে হচ্ছে কেন? ‘ভারত’ কল্পনার মধ্যে মহা গলদ আছে।

এই যখন বাস্তবতা তখন ‘কল্পনা’ ব্যাপারটাকে ভারতীয় সংবিধান দিয়ে সমাধান করা যায় না। আইন করে কল্পনা নিষিদ্ধ বা দমন করা যায় না। NRC/ CAB ইত্যাদি করে শেষ রক্ষা হবে না, রক্তপাত ছাড়া। রাজ্য ও কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব কথাটার মানে এই ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কল্পনা এবং কল্পনাশক্তির দ্বন্দ্ব। তাহলে সকলে কল্পনাকে এক জায়গায় নিবদ্ধ করতে হবে। নিবদ্ধ করতে চাইলে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। পরস্পরের সঙ্গে নেগোশিয়েশান বা দেনদরবারের জায়গা শক্তিশালী করতে হবে।

কোন সংবিধান দিয়েই কল্পনাকে আটক রাখা যায় না। শুধু আসাম নয়, কাশ্মির, উত্তর-পূর্ব ভারত এমনকি পশ্চিম বাংলাকেও পারা যাবে কিনা এখন সন্দেহ হচ্ছে।

৪. কল্পনা, ভূগোল ও ভারত
………………………………

দেখুন কাণ্ড! উনিশ শ পাঁচের পরে উনিশ শ বিশ সাল গেল, এরপর একাত্তরে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করল, কিন্তু পশ্চিম বাংলার হিন্দু বাঙালির ঘুম ভাঙল না। নিজেদের জাতিবাদী হিন্দু ছাড়া বাঙালি হিশাবে নিজেদের কল্পনা করতে ব্যর্থ হোল।

এখন নতুনেরা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছে। দিক। দেরি হোল, কিন্তু হচ্ছে তো। এটাই আশার কথা। পশ্চিম বাংলার হিন্দু রাজনৈতিক ভাবে বাঙালি হতে না পারার অক্ষমতাকে কলোনিয়াল শাসনের কুফল হিশাবে বুঝতে হবে। হিন্দু বলে পারে নি, তা মোটেও নয়। চিরায়ত ‘হিন্দু’ বলে কিছু নাই। সিন্ধু নদীর তীরে আধুনিক ‘হিন্দু’ বলে কিছু ছিল না। ছিল বহু ভাষা, ধর্ম, জাতি ও জীবন যাপন। হিন্দু শুধু না, আমরা সকলেই ছিলাম। ঔপনিবেশিক আমলেই মুসলমানদের বিপরীতে বাকি সকলকে ‘হিন্দু’ বলার চল শুরু হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষত শুকানো এতো সহজ না।

তাই পশ্চিম বাংলার তরুণরা যখন নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির দাবি নিয়ে দাঁড়ায় আমরা এপাশে উৎসাহিত বোধ করি। কারণ ভাষা এবং সংস্কৃতির মধ্যেই আমরা বাঁচি। এর বাইরে জীবের বাঁচা আছে। খেয়েদেয়ে প্রভুর ভাষায় কথা বলে জীবন কাটানো যেমন। নিজের ভাষায় নিজেকে বর্তমান করে তোলা কঠিন কাজ। পশ্চিম বাংলার তরুণরা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। বাংলাদেশে আমরা রক্ত দিয়ে এবং নানান ব্যর্থ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি ‘ইতিহাসের সমান বয়সী’ হওয়ার চেষ্টা সহজ সাধনা নয় । কিন্তু এই কাজ ছেড়ে দেবার প্রশ্নই আসে না।

নগদ লাভ এটুকুই যে বাংলাদেশ হয়তো লড়তে লড়তে দাঁড়িয়ে যাবে। বাঙালিও যৌথ ভাবে দাঁড়াবে সীমান্তের এদিকে আর ঐদিকে। কিন্তু সেটা যেন কোন দিকেই উগ্র জাতিবাদে রূপ না নেয়। বরং সেটা পুরা দক্ষিণ এশিয়াকে মাথায় রেখে নিখিল গণতান্ত্রিক হিন্দুস্তানের ধারণায় রূপ নিক, সেটাই কাম্য। স্বাধীন জাতি এবং সকলের নিজ নিজ ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রধান গণ্য হোক। গড়ে উঠুক নানান ধর্ম ও ভাষাভাষীর সম্বন্ধ। গড়ে উঠুক রাষ্ট্রপুঞ্জের গণতান্ত্রিক ঐক্য।

ঠিক। শুধু ভাঙা না, গড়ার কথাটাই আগে থাকতে মাথায় থাকতে হবে। যদি চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও রাশিয়ার বিপরীতে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণকে টিকে থাকতে হয়, তাহলে তাদের নতুন করে কল্পনা করতে শিখতে হবে। এরপর আসবে সম্ভব অসম্ভরের তর্ক। হোক। কিন্তু নতুন ভাবে কল্পনা করতে চাই। উপমহাদেশ দক্ষিন এশিয়ার জনগণের ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক শক্তি হিশাবে হাজির হোক। আমরা নতুন ভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে গড়ে তুলবার কল্পনা করতে শিখি। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় চিন, আমেরিকা, ইউরোপ ও রাশিয়ার বিপরীতে দক্ষিন এশিয়াকে নতুন ভাবে গড়বার প্রয়োজন রয়েছে।

৫. কল্পনা, ভূগোল ও ভারত
………………………………

কল্পনা কি জিনিস, আর সেটা যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনা হয় তাহলে তার শক্তি কেমন সে বিষয়ে আমাদের বিশেষ ধারণা নাই। আমরা দাবি করেছি, ‘ভারত’ কল্পনা বটে, কিন্তু কল্পনা মানেই অবাস্তব বা অসম্ভব কিছু না। ভারতের ‘বর্তমান’ হতে পারা কল্পনারই বাস্তবায়ন।

এই কল্পনা কার? হতে পারে ঔপনিবেশিক আমলে নতুন পরিগঠিত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির। কিম্বা এই কল্পনা কেউ প্রকাশ করার পর নতুন কল্পনা কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি গড়ে উঠেছে। নিজের প্রতিভা গুণে কিম্বা ঔপনিবেশিক আমলে নতুন পরিগঠিত ভদ্রলোক বাবুদের কল্পনাকে গুছিয়ে যিনি হাজির করেছেন তিনি একজন কবি। কল্পনাকারীর নাম শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ ২৭ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে কলকাতায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বাৎসরিক সভার দ্বিতীয় দিনে লিখলেন। “জনগণমন অধিনায়ক জয় জয় ভারত ভাগ্যবিধাতা’। ‘ভারত’ নামক নতুন ভাগ্যবিধাতা কল্পনার জগত থেকে কাব্যে হাজির হয়ে গেল। ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবী চৌধুরানি গানটি গেয়েছিলেনও খুব সুন্দর। বলা যায়, এই তো ‘ভারত’ আইসা গেল। ব্রাহ্মসমাজের ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ১৯১২ সালে ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ শিরোনামে গানটি ছাপল। ‘ভারত’ প্রচারিত হতে শুরু করল। কল্পনা থেকে ‘ভারত-এর বাস্তবে হাজির হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল।

ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ অন্ধ্র প্রদেশের ‘বেসান্ত থিওসফিকাল কলেজ’-এর অনুষ্ঠানে গানটি গাইলেন। কলেজের কর্তৃপক্ষ উৎসাহিত হয়ে গানটির ইংরেজি অনুবাদ তাদের প্রার্থনাসঙ্গীত হিশাবে গ্রহণ করলেন। আইরিশ কবি জেমস কাজিনের স্ত্রী মার্গারেট কাজিন রবীন্দ্রনাথের গানটির স্বরলিপি তৈরি করলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন

এরপর এল ১৪ অগাস্ট ১৯৪৭। ইন্ডিয়ান কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলি প্রথম বারের মতো মধ্যরাতে বসেছে। এসেম্বলি শেষ হোল সবার সম্মতি ক্রমে ‘জনগণমন অধিনায়ক ভারত ভাগ্য বিধাতা’ গানটি গেয়ে। কল্পনার ভারত প্রথমে রূপ নিল কবির ছন্দে ভাষায় এবং অক্ষরে। এরপর সেই কল্পনার ইংরেজি অনুবাদ বাংলা না জানাদের মধ্যেও ছড়িয়ে গেল। অতঃপর ইন্ডিয়া কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলির মধ্য দিয়ে এই গান একটি সাংবিধানিক বা গঠনতান্ত্রিক মর্যাদা লাভ করল। কল্পনা থেকে ভারত মূর্ত হোল।

কল্পনা বলবৎযোগ্য। কিন্তু তার জন্য শুরুতে শক্তি প্রয়োগ বা সশস্ত্র ভূমিকার দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে একজন রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু কল্পনাকে যখন বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চলে তখন বোঝা যায় প্রাচীন কল্পনার উপযোগিতা ফুরিয়েছে। দরকার নতুন কল্পনার।

এখন বা এবারের কল্পনা কোন ধর্মীয় জাতিবাদী বা হিন্দুত্ববাদীর কল্পনা হবে না, এক জাতির কল্পনা দিয়ে অন্য ধর্ম, ভাষা বা জাতিগোষ্ঠি নিপীড়নের দিন দ্রুত শেষ হয়ে আসছে কি? বোধ হয়। তাই ‘ভারত’ নামক হিন্দুত্ববাদী কল্পনার উপযোগিতাও শেষ হচ্ছে দ্রুত। এখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছি ভারতের ভাগ্য বিধাতা সেকুলার নয় একদমই। ঘোরতর সাম্প্রদায়িক।

হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিপরীতে নতুন কল্পনার আবির্ভাব অতি সত্বর ঘটবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু ঘটবে, এটা বোঝা যায়। পুরানা কল্পনার উপযোগিতা ফুরিয়ে যাবার পর নতুন কল্পনার জন্য ইতিহাসকে অপেক্ষা করতে হয় বৈকি। কিন্তু ঘটে।

কল্পনা দারুন ব্যা্পার। কল্পনা করতে পারা অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক শক্তি। সেইশক্তির ভালমন্দ রাষ্ট্র বিজ্ঞান এখনও পুরাপুরি বোঝে না। কিম্বা ধরতে পারে না। উপমহাদেশে কল্পনার ভূমিকা আগের চেয়ে স্পষ্ট। নিজেদের নতুন করে কল্পনা করা ও ভাবতে পারার প্রয়োজন বাড়ছে।