কলম্বিয়া যেভাবে শান্তির পথে

  • আসাদ পারভেজ
  •  ১৯ জুলাই ২০২২, ১৯:৫১

কলম্বিয়া যেভাবে শান্তির পথে – প্রতীকী ছবি

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের বহুল আলোচিত দেশের নাম ‘কলম্বিয়া’। কলম্বাসের নামে স্বাধীন ভূমি ‘কলম্বিয়া’। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত দেশটি ১৮১৯ সালের আগে স্পেনের উপনিবেশ ছিল। ১৮১৯ সালে ‘সাইমন বলিভার’র নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী স্পেনিশ বাহিনীকে পরাজিত করে পরাধীন ভূমিতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ায় দেশটির জনগণ।

কলম্বিয়ার ইতিহাস রক্তপাত ও সংগ্রামের কাহিনীতে ভরপুর। কখনো স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে, কখনো অন্তর্কলহে, ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কিংবা একটি সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ গড়ার লড়াইয়ে রক্তক্ষয় হয়েছে। দেশটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাদক উৎপাদনকারী ও চোরাচালানের জন্য খ্যাত। কিছু গেরিলা সংগঠনের জন্মের ভেতর দিয়ে কলম্বিয়া হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠে। যারা অঞ্চলকেন্দ্রিক স্বাধীনতা দাবি করে। আবার কিছু সংগঠন পুরো সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে গঠিত Revolutionary Armed Forces of Colombia (FARC) এমনই একটি সংগঠন যার প্রতিষ্ঠাতা ম্যানুয়েল ভেলেজ। মার্কসবাদী গেরিলাগোষ্ঠী ফার্ক কলম্বিয়া সরকারের কাছে বিদ্রোহী জঙ্গি গ্রুপ হলেও অন্যদের কাছে গেরিলা সংগঠন। গোষ্ঠীটি ‘কলম্বিয়ার বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনী’ নামে সুপরিচিত।

ফার্ক প্রতিষ্ঠার পেছনের কাহিনী :
চরম দারিদ্র্যই কলম্বিয়ার মাটিতে বামপন্থী চিন্তাচেতনার জন্ম দেয়। দরিদ্র জনতার মাঝে শিক্ষামন্ত্রী হোর্হে গাইতান ছিলেন বামঘেঁষা জনপ্রিয় নেতা। তিনি আমজনতাকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাতেন। ১৯৪৮ সালে নির্বাচনে যখন তার প্রেসিডেন্ট হওয়া প্রায় নিশ্চিত তখনই তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। এতে শুরু হয় দাঙ্গা, যা ১০ বছর ধরে চলে। দুই লাখ জীবনহানির বিনিময়ে ১৯৫৮ সালে এই দাঙ্গা শেষ হয়। এই সময় ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে যৌথভাবে ক্ষমতায় আসে উদার ও রক্ষণশীল ঘরানার দুটি দল। কিন্তু গুমোট পরিস্থিতি আর ধনী দরিদ্রের বৈষম্য থেকে দেশটি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

মার্কেতালীয় প্রজাতন্ত্র বনাম ফার্কের উত্থান :
১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় বসা ন্যাশনাল ফ্রন্ট জনতার ওপর নিপীড়ন শুরু করে। সে সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করে। ন্যাশনাল ফ্রন্ট অস্তিত্ব বাঁচাতে দেশের কৃষিজমির বিশাল অংশ মার্কিন ব্যবসায়ীর কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয়। এতে করে চার লাখের বেশি লোক বেকার হয়ে শহরে আশ্রয় নেয়- যা থেকে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

সঙ্কটময় সময়ে বামদের উৎসাহে দেশের দক্ষিণাংশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক-শ্রমিক সম্মিলিতভাবে প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলে। ১৯৬১ সালে ম্যানুয়েল ভেলেজ কলম্বিয়ার দক্ষিণাংশের পাহাড়গুলোর একটি এলাকাকে মার্কেতালীয় প্রজাতন্ত্র নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় সরকারি বাহিনীর আক্রমণ। অবশেষে ৬০০ বর্গকিলোমিটারের এই প্রজাতন্ত্রে ১৯৬৪ সালে স্বাধীনতার মহাস্বপ্নে ৪৮ জন মিলেশিয়া ফার্ক প্রতিষ্ঠা করেন।

রাশিয়া আর কিউবার সহায়তায় কলম্বিয়ার মাটিতে ফার্ক ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র আর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তিশালী সেনাদল গঠন করে। শুরু হয় সরকার বনাম ফার্কের দর কষাকষি। ১৯৮৪ সালে কলম্বিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য বামদল নিয়ে তারা প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন নামে নতুন দল গঠন করে। নব্বই দশকের পরপরই শুরু হয় দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ। দেশের বিশালাংশ ফার্ক গেরিলাদের হাতে আসে।

একপর্যায়ে অর্থের প্রয়োজনে মাদক পাচার, অপহরণের মত কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে দলটির জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পায়। ২০ হাজার সদস্যের সেনাদল নিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্ব আর দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে প্রায় দেড় লাখ বর্গমাইল নিয়ন্ত্রণে নেয় গেরিলা সংগঠন ফার্ক। একুশ শতকে এসে সরকার আর ফার্কের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। এই সময়ে ফার্ক প্রতিষ্ঠাতা ম্যানুয়েল ভেলেজ মারা যান। তার মৃত্যুর পর ২০০৮-০৯ সালে বহু যোদ্ধা নিহত ও আহত হয়। বাম নেতা আলফান্সো কানো (মোনো জোজেই) নিহত হওয়ার পর ফার্ক অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে।

২০১২ সালে হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। তার আহ্বানে সরকার ও ফার্ক এক টেবিলে বসতে রাজি হয়। অবশেষে কিউবার মধ্যস্থতায় ৪৮ বছরের সশস্ত্র সঙ্ঘাতের ইতি টানতে ২০১২ সালে রাজধানী হাভানাতে কলম্বিয়ার সরকার ও বিদ্রোহী ফার্ক গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। কলম্বিয়ার সরকার এই আলোচনাকে ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করে।

২০১৬ সালের ২৩ জুন কিউবার রাজধানী হাভানায় প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন, চিলির প্রেসিডেন্ট মিশেল বেচলেট, নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্গ বেরেন্ডাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস ও ফার্ক কমান্ডার রডরিগো এক ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর কিউবার রাজধানী হাভানায় কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস বলেন, শান্তিতে বসবাস করার মানে কী তাও আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আজ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে। আশা করি দেশে শান্তি ফিরবে এবং আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তির ইতিহাস রেখে যাবো।

বিশ্লেষকদের ধারণা, গত ৫২ বছরে কলম্বিয়ার সরকার ও বিদ্রোহী ফার্ক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার মানুষ মারা গেছে এবং ৫০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

পাঁচ দশকের বেশি সময়ের রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে কলম্বিয়ার সরকার ও ফার্ক বিদ্রোহী গোষ্ঠী ঐতিহাসিক এক শান্তিচুক্তিতে উপনীত হয়। ২০১২ সালে কিউবার মধ্যস্থতায় শান্তির উদ্যোগ সাড়ে তিন বছরে এসে ২০১৬ সালের ২৩ জুন হাভানায় তা যুদ্ধবিরতি (অস্ত্রবিরতি) চুক্তির মাধ্যমে শান্তির সাফল্য দেখতে পায়। ২৪ আগস্ট ২০১৬ সালে হাভানায় এক অনুষ্ঠানে কলম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান উমবেরতো দে লা চাল্লে ও বামপন্থী গেরিলা বাহিনী রেভলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া (ফার্ক)-এর প্রধান আলোচক ইভান মার্কেজ ‘ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি’তে সই করেন।

দীর্ঘ সংগ্রামের পর কলম্বিয়ার ভ‚মিতে বিস্তৃতভাবে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সঙ্ঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং স্থিতিশীল ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে উভয়পক্ষ একসঙ্গে কাজ করতে একমত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাতে ফার্ক অস্ত্র সমর্পণ করে বেসামরিক জীবনে ফিরে যাবে। চুক্তি শেষে কলম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান উমবেরতো দে লা চাল্লে বলেন, ‘আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি; যুদ্ধ শেষ, এখন নতুন সূচনা।’

ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিটি বিশ্বনেতারা সাধুবাদ জানালেও কলম্বিয়ার সব সাধারণ জনগণের কাছে তা গ্রহণীয় হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে বিরোধীদলীয় নেতা কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যালভারো উরিব চুক্তিটির ঘোর বিরোধিতা করেন। তার মতে, চুক্তিটিতে বিদ্রোহীদের খুব বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে। তিনি কলম্বিয়ার জনগণকে গণভোটে চুক্তিটিকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানান। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২ অক্টোবর ২০১৬ গণভোটে মানুষ শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে।

ফলে সরকারের সাথে ফার্কের শান্তিচুক্তি বাতিল হয়ে যায়। এতে প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস হতাশ হলেও দমে যাবার মানুষ নন। তিনি শান্তিচুক্তিটি আরো গ্রহণযোগ্য করতে চুক্তির প্রশ্নবিদ্ধ ধারাগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেন। প্রেসিডেন্ট সান্তোস মানসিকভাবে কলম্বিয়ায় বিরাজমান সংঘর্ষ নিরসনে অসামান্য অবদান রাখেন। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়।

১২ অক্টোবর ২০১৬ ফার্ক নেতা টিমোলিয়ন হিমেনেজ শান্তিচুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট সান্তোস পরে ফার্কের সাথে শান্তিচুক্তির কিছু পরিবর্তন নিয়ে বিরোধী দলের সাথে বৈঠক করেন। এর ভিত্তিতে চুক্তিতে ৫০টিরও বেশি পরিবর্তন আনা হয়। ২২ নভেম্বর ২০১৬ সালে হাভানায় কিউবা ও নরওয়ের মধ্যস্থতায় কলম্বিয়ার সরকার ও ফার্ক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

কলম্বিয়ায় ফার্ক ছাড়াও গত পাঁচ দশক ধরে ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি নামক আরেকটি দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে। লিবারেশন আর্মির সাথে ২৭ অক্টোবর ২০১৬ সালে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোতে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তি আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেন।

প্রায় দু’হাজার ৫০০ যোদ্ধার ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সাথে কলম্বিয়া সরকারের শান্তিপ্রক্রিয়া শুরুর পেছনে অন্যতম উদ্যোক্তা ভেনিজুয়েলাসহ নরওয়ে, কিউবা, চিলি, ব্রাজিল ও ইকুয়েডর। ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে গেরিলা সংগঠন ফার্ক রাজনৈতিক দল হিসেবে Alternative Revolutionary Forces of Colombia নামে কাজ করে যাচ্ছে।