ইউনেসকোর মতে, শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির ৬% এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় ৫% থাকা উচিত।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেশের কর-জিডিপির হার কম। বহু সময় নষ্ট হয়ে গেলেও এ নিয়ে সরকারের কোনো কাজ নেই। এ হার বাড়াতেই হবে। নইলে সরকার কোনো চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করতে পারবে না।
এ সময় ‘গ্লোবাল অ্যান্ড রিজিওনাল ইকোনমিক আউটলুক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শ্রীনিভাসন। এতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর আর্থিক চিত্র তুলে ধরা হয়।
তিন দিনের প্রশিক্ষণে এসএআরটিটিএসির পরিচালক ডেভিড কাউয়েন, আইএমএফের যোগাযোগ বিভাগের উপদেষ্টা নাগওয়া রিয়াদ, সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ কর্মকর্তা টিং ইয়ান ও নির্ধারিত প্রশিক্ষক ম্যাথিউ রবিনস এবং রয়টার্সের সাবেক সাংবাদিক স্ট্যানলি কার্ভানহো বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি এবং জিডিপির তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় নিয়ে কথা বলেন শ্রীনিভাসন। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’র তথ্যের ভিত্তিতে তিনি জানান, বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় ২ শতাংশের কম। অথচ নিম্ন আয়ের অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এ হার ৪ শতাংশের বেশি, আর উদীয়মান দেশগুলোয় ৫ শতাংশের কাছাকাছি। জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকোর মতে, এ হার ৬ শতাংশ হওয়া উচিত।
শ্রীনিভাসন তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশের কম। অথচ নিম্ন আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এ হার জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ ও উদীয়মান দেশগুলোয় জিডিপির প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশের মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, তা হওয়া উচিত জিডিপির ৫ শতাংশ।
গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ। এর মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ ৩৩০ কোটি ডলার ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ ১৪০ কোটি ডলার।
শ্রীনিভাসন বলেন, ইসিএফ ও ইএফএফ বাবদ ঋণ নেওয়ার কারণে মোটা দাগে ছয়টি কাজ করতে হবে বাংলাদেশকে। সেগুলো হচ্ছে—কর আদায় বৃদ্ধি, জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ হ্রাস, মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ, ব্যাংক খাতে নজরদারি ও সুশাসন বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়ানো।
শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, প্রায় গোটা বিশ্বেই কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশে নিম্নতম—শ্রীনিভাসনের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের সমস্যা। তবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে যেসব শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো পূরণ করলে ভালো একটা ইতিবাচক ফল আসবে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রীনিভাসন ঠিক বিষয়টিই ধরেছেন। তবে আমরা এ কথা বহু বছর ধরেই বলে আসছি। প্রশ্ন হচ্ছে, কর-জিডিপি হার এখানে কেন কম? আমার মতে, দুটি বড় কারণ এর পেছনে আছে। একটা হচ্ছে কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, আরেকটা কর অব্যাহতি।’
রিজার্ভ বেড়েছে, ভর্তুকি কমেছে
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বহুমাত্রিক সমস্যায় পড়েছে বলে মন্তব্য করেন শ্রীনিভাসন। এগুলো হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমে যাওয়া ইত্যাদি। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বেশি। এদিকে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি (৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার) পাওয়ার পর রিজার্ভ একটু বেড়েছে।
১ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২১৯ কোটি ডলার, যা আইএমএফের প্রথম কিস্তি পাওয়ার পরদিনই বেড়ে ৩ হাজার ২৬৯ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।
শ্রীনিভাসন ভর্তুকি প্রসঙ্গে বলেন, সব ভর্তুকি ভালো নয়। আর গ্যাসের ভর্তুকি তো গরিবেরা পান না, পান ধনীরা। ভর্তুকির যৌক্তিকতা চায় আইএমএফ। কাকে ভর্তুকি দিতে হবে—সরকারেরই তা ঠিক করা দরকার।
প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থা
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ডলারের বিপরীতে এশীয় দেশগুলোর মুদ্রামান সম্প্রতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। ভারতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা ভালো। শ্রীলঙ্কার কর-জিডিপির হারও বাংলাদেশের মতোই নিম্নতম। শ্রীলঙ্কাকে কর-ব্যবস্থায় সংস্কার করতে ও দুর্নীতি কমাতে হবে।
ভুটানের সামস্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে। রিজার্ভও কমেছে। পর্যটকভিত্তিক আয়ের দেশ মালদ্বীপের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলেও মহামারির আগের অবস্থায় চলে এসেছে।
আইএমএফের ব্লগে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে ৬ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেশের কর-জিডিপির হার কম। বহু সময় নষ্ট হয়ে গেলেও এ নিয়ে সরকারের কোনো কাজ নেই। এ হার বাড়াতেই হবে। নইলে সরকার কোনো চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করতে পারবে না।’