ইসমাইল আলী: দেশের গ্যাস মজুত ফুরিয়ে আসছে, যা নিয়ে কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। তবে মজুত কতটা আছে, কতদিন চলবে, মজুত ফুরিয়ে গেলে বিকল্প কী হবে এসব বিষয় নিয়ে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। এমনকি সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পরও গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে উদ্যোগ খুব একটা এগোয়নি। এমনই পরিস্থিতিতে বড় দুঃসংবাদ দিল জ্বালানি বিভাগের অধীন হাইড্রো কার্বন ইউনিট।
সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুতের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯২৬৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ২০ দশমিক ৩৫৩৪ টিসিএফ, যা মজুতের ৬৮ শতাংশ। ওই সময় দেশে অবশিষ্ট গ্যাস মজুত ছিল ৯ দশমিক ৫৭৩১ টিসিএফ বা ৩২ শতাংশ। যদিও অবশিষ্ট মজুত থেকে কিছু গ্যাস উত্তোলন করা যাবে না। কারণ চাপ কমে এলে প্রতি ফিল্ডেই কিছু গ্যাস উত্তোলন করা যায় না।
তথ্যমতে, কয়েক বছর ধরে দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটির অধীন তিনটি ক্ষেত্রে গ্যাস মজুত ছিল সাত দশমিক ৬১২৭ টিসিএফ। এর মধ্যে সাত দশমিক ৫৪২৩ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ শেভরনের অধীন ক্ষেত্রগুলো থেকে ৯৯ শতাংশের বেশি গ্যাস মজুত শেষ। বর্তমানে কোম্পানিটির অধীন জালালাবাদ ক্ষেত্রে কোনো গ্যাস মজুত নেই। আর মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানায় সামান্য গ্যাস মজুত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় গ্যাস সরবরাহের অর্ধেকেরও বেশি আসছে শেভরনের ক্ষেত্রগুলো থেকে। তবে কয়েক বছর ধরে এগুলো থেকে বাড়তি গ্যাস সরবরাহের কারণে তাদের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। যদিও দেশে গ্যাস মজুতের অর্ধেকেরও বেশি আছে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পরিচালনাধীন গ্যাসক্ষেত্রে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোম্পানিগুলো সরবরাহ সেভাবে বাড়াতে পারেনি। দেশে গ্যাসের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এখনই স্থানীয় সরবরাহের বিকল্প চ্যানেল বা সরবরাহ লাইন তৈরি করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে গ্যাস খাত।
এদিকে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের ক্ষেত্রগুলো থেকে। এ কোম্পানির অধীনে ছয়টি ক্ষেত্রে মজুত ছিল ১২ দশমিক ২৫২০ টিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৯ দশমিক ২৫০২ টিসিএফ বা ৭৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর অবশিষ্ট রয়েছে তিন টিসিএফের কিছুটা বেশি গ্যাস।
উত্তোলনের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি। এ কোম্পানির অধীনে পাঁচটি ক্ষেত্রে গ্যাস মজুত ছিল সাত দশমিক ০৩৩ টিসিএফ। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৮৫৫৯ টিসিএফ বা ২৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর অবশিষ্ট রয়েছে পাঁচ দশমিক ১৭৭১ টিসিএফ গ্যাস।
এ তিনটি ক্ষেত্রের বাইরে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের অধীন বাখরাবাদে শূন্য দশমিক ৫১৫১ টিসিএফ, সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের অধীনে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৪৪৮২ টিসিএফ গ্যাস রয়েছে এবং বাপেক্সের অধীন সেমুতাং গ্যাস ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৩০৩৭ টিসিএফ গ্যাস মজুত রয়েছে। তবে অন্যান্য গ্যাস ক্ষেত্রে মজুতের পরিমাণ শূন্য দশমিক দুই টিসিএফেরও কম।
তথ্যমতে, বর্তমানে বাপেক্সের অধীনে গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে আটটি। এগুলোয় গ্যাস মজুত ছিল এক দশমিক ৪৬০৮ টিসিএফ, যার মধ্যে শূন্য দশমিক ৬০৬৬ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। আর অবশিষ্ট রয়েছে শূন্য দশমিক ৯০০২ টিসিএফ। বহুজাতিক তাল্লোর অধীন রয়েছে একটি গ্যাস ক্ষেত্র। এতে মজুত ছিল শূন্য দশমিক ৬২১ টিসিএফ। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৫৪৬০ টিসিএফ এবং মজুত রয়েছে শূন্য দশমিক ০৭৫ টিসিএফ।
অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানি সান্তোস ও নাইকো বর্তমানে কোনো গ্যাস সরবরাহ করছে না। এ দুই কোম্পানির অধীনে দুটি গ্যাস ক্ষেত্র ছিল। ওই দুই ক্ষেত্র থেকে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৪৮৯৫ টিসিএফ ও শূন্য দশমিক ০৬৩ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছিল।
গত জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশে মজুত গ্যাসের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ০৬ টিসিএফ। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে বিবেচনায় অবশিষ্ট মজুত গ্যাস দিয়ে প্রায় ১১ বছর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এছাড়া নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের বিভিন্ন কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, শেভরনের গ্যাস সরবরাহ হ্রাসের ফলে সৃষ্ট ঘাটতি দেশীয় কোম্পানিগুলোর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ তারা নিজেরাই বছরের পর বছর ধরে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুত নিয়েও গ্রিডে সরবরাহ করেছে কম। এখন যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তাতে বড় ধরনের কোনো গ্যাস সরবরাহ গ্রিডে আসবে না।
সূত্র : শেয়ার বিজ