কর্মকর্তাসহ আসামি ৯৫২ পুলিশ

কর্মকর্তাসহ আসামি ৯৫২ পুলিশকোলাজ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ৯৫২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে এসব মামলা হয়। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৮ পুলিশ সদস্য। আসামির তালিকায় ছয়জন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক, সাবেক ৩৬ অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, ৫ জন অতিরিক্ত আইজিপি, সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, পরিদর্শক, উপপরিদর্শক, কনস্টেবল ছাড়াও বিভিন্ন পদ-পদবির সদস্য রয়েছেন। বিভিন্ন মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, পুলিশ তার অস্ত্র ব্যবহার করবে জনস্বার্থে ও আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে। আইন সবার জন্য সমান। ন্যায়ানুগভাবে এসব মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করা উচিত। মামলা নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দোষী-নির্দোষ চিহ্নিত করতে বিলম্ব হলে বাহিনীর সদস্যদের মনোবলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি এনামুল হক সাগর বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে দায়ীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। নিরপরাধ হলে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশ বা অন্য যে কোনো মানুষের জন্য একই নীতি। দোষী হলে চার্জশিটে নাম থাকবে। আর অপরাধে যুক্ত না হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত ২৮ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মামলা তদন্তে মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। যথাযথ তদন্তে সক্ষম পুলিশ সদস্যদের দিয়ে মামলার তদন্ত করা হবে। সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী ‘মেনটরিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং তদন্তে বিপুল অভিজ্ঞতা আছে– এমন সদস্যদের নিয়ে আলাদা ‘মেনটরিং টিম’ করা হচ্ছে। তারা প্রতি জেলায় ও থানায় গিয়ে মামলার তদন্তে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।

জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে নির্বিচার গুলি ও মানুষ হত্যার ঘটনা বাহিনীর ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলপ্রয়োগের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার দাবি নানা মহল থেকে ওঠে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পুলিশের সাবেক ও বর্তমান বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তারের জন্য মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে আবেদন করা হয়। এর পর বিভিন্ন ধাপে ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এক কর্মকর্তার অভিযোগ, অনেককে বিপাকে ফেলতে ষড়যন্ত্র করে আসামির তালিকায় নাম দেওয়া হয়। ব্যাচমেট ছাড়াও পুলিশের কিছু সদস্য এর সঙ্গে জড়িত। কেউ আবার বাদীপক্ষকে নাম ঢুকাতে প্রলুব্ধ করেছেন, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। তাদের ভাষ্য, প্রকৃত দোষীদের বাইরে নিরাপদ কাউকে আসামি করা হলে মামলার গুরুত্ব নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন ভুক্তভোগী।

কারও কারও অভিমত, মামলায় নিরপরাধ কাউকে ষড়যন্ত্রমূলক আসামি করা হলে বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পরিবারের সদস্যরা।

একাধিক মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে একই মামলায় আসামি করা হয়েছে। আসামিদের সবাইকে বাদী চেনেন না। খিলগাঁও থানায় ৫ অক্টোবর বাদী হয়ে একটি মামলা করেন মো. সোহেল নামে এক যুবক। ওই মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী, একাধিক ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পরিবহন নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, খুলনা, বগুড়া, পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের আসামি করা হয়। ৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৬০-৭০ জন আসামি। এজাহারে বলা হয়, ৪ আগস্ট বিকেলে পুলিশের ছোড়া গুলির আঘাতে বাদী ডান হাত ও কপালে গুরুতর আঘাত পান। ১৭ সেপ্টেম্বর মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরদিন অস্ত্রোপচারর পর গুলি বের হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। ওই মামলার একাধিক অভিযুক্ত সমকালকে বলেন, ঘটনার দিন তারা ওই এলাকায় যাননি। তথ্য-প্রযুক্তিগত তদন্ত করলে তা বেরিয়ে আসবে। বাদীর নম্বরে ফোন করলে রুবেল নামে একজন সোহেলের মামা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আসামি সবাইকে আমরা চিনি না। এমন মামলা তো আরও হচ্ছে। পুলিশ তদন্ত করুক।’

মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছয়জন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মামলার আসামি হয়েছেন। তারা হলেন– চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, বেনজীর আহমেদ, হাসান মাহমুদ খন্দকার, জাবেদ পাটোয়ারী ও এম সানাউল হক। মামুনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৫৫টি, শহীদুল হকের নামে ২৩টি, বেনজীরের বিরুদ্ধে ১১টি, হাসান মাহমুদ খন্দকারের বিরুদ্ধে ৭টি, জাবেদ পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে দুটি ও সানাউলের বিরুদ্ধে একটি।

এ ছাড়া আসামির তালিকায় ৩৬ জন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি, পাঁচজন অতিরিক্ত আইজিপি, ১২ জন সাবেক ডিআইজি, ১১ জন ডিআইজি,  সাবেক দুই অতিরিক্ত ডিআইজি, ৪২ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, সাবেক তিন পুলিশ সুপার,  ৫৯ জন পুলিশ সুপার, ৫৬ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ২১ জন সহকারী পুলিশ সুপার এবং ১৬৮ জন পরিদর্শক রয়েছেন। বাকিরা উপপরিদর্শক, সহকারী উপপরিদর্শক ও কনস্টেবল।

মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা, ১৭১টি। ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১৭টি, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ১২৫টি, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৪৬টি ও অতিরিক্ত ডিআইজি এস এম মেহেদী হাসানের নামে ৩১টি।

আরও যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আসামি
আসামির তালিকায় আছেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, ইকবাল বাহার, ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান, ইব্রাহিম ফাতেমী, আতিকুল ইসলাম, বনজ কুমার মজুমদার, দিদার আহমেদ, মোহাম্মদ আলী মিয়া, মো. আসাদুজ্জামান, বিনয়কৃষ্ণ বালা, এম খুরশিদ হোসেন, শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান, শেখ হেমায়েত উদ্দিন, সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, খন্দকার লুৎফুল কবীর, কৃষ্ণপদ রায়, বশির আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, এ কে এম হাফিজ আক্তার, ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, সাবেক ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, আব্দুল জলিল মণ্ডল, মো. আসাদুজ্জামান, এস এম মনিরুজ্জামান, নিবাস চন্দ্র মাঝি, শৈবাল কান্তি চৌধুরী, ডিআইজি নূরে আলম মিনা, জাকির হোসেন খান, সাইফুল ইসলাম, সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও এ কে এম নাহিদুল ইসলাম।

ডিসিদের নামে মামলা
ডিসিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৭টি মামলার আসামি মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন। সরকার পতনের পর ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালকে ব্রিফ করছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের তৎকালীন ডিসি ইকবাল। তাঁর মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়…।’ এ সময় সেখানে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও উপস্থিত ছিলেন।

ডিসিদের মধ্যে আসামির তালিকায় আছেন এস এম তানভীর আরাফাত, কাজী মনিরুজ্জামান, গোলাম মোস্তফা রাসেল, তারিক বিন রশিদ, শাহেন শাহ, নুরুল আমিন, জুয়েল রানা, মাহবুব উজ জামান, হাফিজ আল ফারুক, এইচ এম আজিমুল হক, গোবিন্দ চন্দ্র ও রাজীব ফারহান।

পরিদর্শক যারা আসামি
পুলিশ পরিদর্শকের মধ্যে আসামির তালিকায় আছেন– আমিনুল ইসলাম, শাহীনুর রহমান,  খন্দকার মো. হেলাল উদ্দিন, মাহবুবুর রহমান, সাব্বির হোসেন মুন্সী, ফরমান আলী, মাজহারুল ইসলাম, আবুল হাসান, কাজী মঈনুল, শাহ আলম, প্রলয় কুমার সাহা, মো. সেলিমুজ্জামান, মোস্তাবিজুর রহমান, ফারুক আহমেদ, জাকির হোসেন, আতিকুল হক, অপূর্ব হাসান, গোলাম মাওলা, মসিউর রহমান, আশীষ কুমার দেব, খালেদ চৌধুরী, রাজীব শর্মা, আরফাত হোসেন, জিয়াউর রহমান জিয়া, ইয়াসিন গাজী, মাহতাব উদ্দিন, শাহ দারা খান, মাহমুদুল হাসান, রাসেল হোসেন ও সাজ্জাদ হোসেন।

কনস্টেবল যারা আসামি 
আসামির তালিকায় কনস্টেবলদের মধ্যে আছেন– মাহবুব আলম, আব্দুর রশীদ, রমজান মোল্লা, মো. সোলায়মান, আবু সায়েদ, আজহার, জাহাঙ্গীর আলম, ওমর ফারুক, বদরুল আলম, দেবাশীষ অধিকারী, আবু জাফর, মেহেদী, শহীদুজ্জামান, মো. হাসনাত, আবু হাসান, রফিকুল ইসলাম, মো. জাকির, সাইফুল, রাজীব, আরিফুজ্জামান, রাশেদুল, সানোয়ারসহ আরও অনেকে।

samakal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here