বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
পুলিশের হিসাবে মার্চের প্রথম ২০ দিনে বিদেশ থেকে ফিরেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার মানুষ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসেছেন কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশগুলো থেকে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই তাঁরা যাঁর যাঁর বাড়িতে চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৮ হাজার বিদেশফেরত স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে আছেন। অন্যদের কোনো হদিস নেই।
গত সপ্তাহ পর্যন্ত এসব প্রবাসী স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে-গঞ্জে, হাটবাজারে ঘুরেছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এই বিদেশফেরতদের মধ্যে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তা কত মানুষের মধ্যে ছড়াবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণাই করা যাচ্ছে না। মাঠ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশের কর্মকর্তারা এক ‘ভয়ংকর পরিণতি’র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এই অবস্থার বিপরীতে দেশে কোনো প্রস্তুতি খুবই সামান্য। চিকিৎসক-নার্সদের এখন পর্যন্ত ঠিকভাবে সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই সরবরাহ করা হয়নি। জ্বর-কাশি-গলাব্যথার রোগী হাসপাতালে এলেই দূরত্ব বজায় রাখছেন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকেরা।
অনেক স্থানে দেখা যাচ্ছে, করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের অনেকেই নির্বিঘ্নে হাটবাজারে শপিং মলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ কেউ দাওয়াত দিয়ে লোকসমাগম করছেন। কিন্তু পুলিশ এসব লোককে খুঁজে পাচ্ছে না। বিদেশ থেকে ফেরা এসব লোককে কোয়ারেন্টিনে রাখা নিয়ে বিপাকে পড়েছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ফিরে আসা এসব লোক পরিবার ও সমাজের সঙ্গে মিশে গেছেন। ইতিমধ্যে ফিরে আসা বা তাঁদের সংস্পর্শে আসা লোকদের শরীরে করোনাভাইসারের উপসর্গ দেখাও দিয়েছে। তবে পরীক্ষা না করায় সেটা করোনা কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
দিন দশেক আগে যুক্তরাষ্ট্রফেরত দুজন যোগ দিয়েছিলেন এক বিয়ের আসরে, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকেই দুদিন আগে গিয়েছিলেন গাইবান্ধা-৩ আসনের উপনির্বাচনে ভোট দিতে; এরপর এল দুঃসংবাদ। এরপর রোববার জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রফেরত সেই দুই ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। এ নিয়ে সাদুল্ল্যাপুরজুড়ে আতঙ্ক তৈরি হয়। সেই আতঙ্ক এতটাই ব্যাপকতা লাভ করে যে উপজেলা প্রশাসন পুরো এলাকা ‘লকডাউন’ করার অনুমতি চাইলে জেলা প্রশাসন তা নাকচ করে দেয়।
গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছিলেন ৩৩ জন, যাঁদের ৯ জনই শিবচরের। আর এই ৯ জনের মধ্যে ৬ জনের সংস্পর্শে ছিলেন অন্তত ৩৫০ ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে ১০৭ জনকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। বাকি ২৪৩ জনের কোনো হদিস নেই। তাঁদের শরীরে করোনার উপসর্গ আছে কি না, তা কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না।
পুলিশ বলছে, দেশে ফিরে আসা লোকজন যদি স্বেচ্ছায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন না করেন, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তাহলে এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বিদেশফেরত যেসব ব্যক্তি কোয়ারেন্টিনের ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা না মেনে অন্যদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর পুলিশের বিশেষ শাখা মার্চ মাসে যাঁরা দেশে এসেছেন, তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করে। এ সময় দেশে আসা ২ লাখ ৫৭ হাজার দেশি ও ২৬ হাজার বিদেশির তালিকা সারা দেশে পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো হয়। এখন এরা কোয়ারেন্টিনের নিয়মকানুন সঠিকভাবে অনুসরণ করছে কি না, তা জানতে পুলিশ তাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। কোয়ারেন্টিনের শর্তভঙ্গের দায়ে মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও ঝালকাঠিতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণ রুখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম বন্ধ করেছে পুলিশ। মানুষকে সচেতন করছে, তাদের সহায়তা দিচ্ছে। আবার এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় এবং জনস্বার্থ বিবেচনায় পুলিশ সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
এর আগে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছে পুলিশ। বিনা প্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা না করার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করছে। কোথাও কোথাও প্রয়োজনে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে প্রচারণা চালাচ্ছে পুলিশ। করোন বিরোধী বিভিন্ন পরামর্শ এবং সরকারের নির্দেশনা সম্পর্কেও জনসাধারণকে সচেতন করছেও। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই লোকজনের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি করতে শুরু করে। করোনা প্রতিরোধে জেলা, থানা ও ইউনিয়নেও কমিটি করে দেয়। তারপরও এই অঞ্চলে সব লোককে কোয়ারেন্টিনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নুরে আলম মিনা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলায় ৩ হাজার ৮৮০ জন লোক কোয়ারেন্টিনে আছেন। বেশির ভাগ মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব লোক যদি কোয়ারেন্টিনে আসে, তাহলে করোনার বিস্তার থেমে যাবে। মানুষকে তার নিজের প্রয়োজনেই এই কাজে এগিয়ে আসা উচিত।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত ৭০০ লোককে কোয়ারেন্টিনে রাখা সম্ভব হয়েছে। এসব লোকের বাড়ি বাড়ি ফল পাঠিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। তারপরও সব লোক পুলিশের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘বিদেশফেরত মানুষ নিজের উদ্যোগে যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে যাবে। সে ক্ষতি সামাল দেওয়া আমাদের সবার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।’