কিছুদিন আগেও ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুরোধ নিয়ে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ছুটেছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এমনকি ব্যাংকের এমডিসহ শীর্ষ নির্বাহীদেরও এ নিয়ে উদ্যোক্তাদের কাছে থাকত বিশেষ অনুরোধ। এ চিত্র পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে ডলার সংকট। এখন আমদানি চালু রাখতে প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান ও এলসি খোলার অনুরোধ নিয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের কাছে ছুটে আসতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। ব্যাংকে সফলভাবে এলসি খোলা নিশ্চিত করাটাও এখন আমদানিকারক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমডি-পরিচালকদের অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক ও বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর অন্যতম চট্টগ্রামভিত্তিক টি কে গ্রুপ। গ্রুপটির পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফা হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন তো ব্যাংকাররা আর আমাদের কাছে আসেন না। বরং আমাদেরই ব্যাংকারদের কাছে ছুটে যেতে হচ্ছে। কারণ আমার যেহেতু চাহিদা আছে, সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। এলসি খুলতে পদক্ষেপ নেয়াটা এখন এমডি-পরিচালকদেরও মুখ্য কাজ হয়ে গেছে। অথচ আগে এ ধরনের বিষয় কখনই পরিচালক পর্যায়ে আসত না। এলসি খোলাটা আসলে চিন্তার বিষয় হওয়ারও কথা না। কিন্তু ডলার সংকটে ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা অনেক বাড়ায় চিত্রটা বদলে গেছে। আবার তারাও যে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে না, সেটাও বলব না। আসলে আমার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারে কখনো চিন্তাও করিনি যে এলসি খুলতে এত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এখন বড় আরেকটা সমস্যা হলো বিদেশী রফতানিকারকরা বাংলাদেশীদের সঙ্গে ডিল করতে ভরসা পায় না। নানা ধরনের প্রশ্ন করে যেগুলো আগে কখনো শুনতে হয়নি। আবার এমনও হয়েছে যে আস্থার কারণে রফতানিকারক বিদেশে জাহাজে পণ্য লোড করে দিয়েছে। সে জাহাজ বাংলাদেশে এসে ভেসে আছে কিন্তু এলসি পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও ওদিকে জাহাজের বিলম্বজনিত ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে কনডেনসেট বা ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে এ রকম অহরহ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চাহিদা কমিয়ে হলেও উৎপাদন একটা পর্যায় পর্যন্ত ধরে রাখতে এলসি খোলার বিষয়টি বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য, রাসায়নিকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির পণ্য আমদানিকারকদের মধ্যে সর্বোচ্চ রাজস্ব পরিশোধ করে থাকে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই)। গত অর্থবছরেও ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে এমজিআই। এর বিপরীতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব জমা দিয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। চাহিদামতো ডলারের সংস্থান না হওয়া কিংবা এলসি খুলতে না পারায় শিল্প কাঁচামালের আমদানি কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ব্যবস্থার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আর এখন বাস্তবতা এমন যে উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের এলসি খোলার প্রয়োজনে ব্যাংকারদের খুঁজে নিতে হয়। আবার এলসি খুলতে গেলে বলে শতভাগ মার্জিনের কথা কিংবা ডলার বাইরে থেকে কিনে দিতে হবে। এখন তো এভাবেই চলছে। আমদানি এভাবে কমতেই থাকলে সরকারকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে।’
ভারী শিল্প খাতগুলোর মধ্যে ইস্পাতে নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামভিত্তিক বিএসআরএম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলীহুসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বিজনেস কমিউনিটিতে ধরনা দিতেন এলসি খুলতে। এখন কোম্পানিকেই ব্যাংকের পেছনে ঘুরতে হচ্ছে শুধু এলসির জন্য। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের এজন্য অনেক সময়ও ব্যয় করতে হচ্ছে। বিষয়টি আসলে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ ব্যাংকারদেরও পরিস্থিতি সামলাতে রেশনিং করতে হচ্ছে। এত খারাপ পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি। আমাদের যে ব্যবসা অর্থাৎ ইস্পাতের কাঁচামালের দাম যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কমে যায় তখনই কিনে ফেলতে হয় । কিন্তু দাম যখন কম ছিল, চেষ্টা করেও আমরা এলসি খুলতে পারিনি। পারলে ভোক্তা পর্যায়ে নিশ্চিতভাবেই একটা রিজনেবল দামে বিক্রি করা যেত। উপযুক্ত সময়ে চাহিদামতো কাঁচামাল কিনতে পারার চয়েসটাই আমাদের আর নেই। অর্থাৎ যখন এলসি পাব তখন কিনব, দাম তখন আন্তর্জাতিক বাজারে যেমনই থাকুক না কেন। উৎপাদনে ব্যয় বাড়ার এটাই বড় কারণ।’
ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে প্রায় দুই বছর আগে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা হাকিম গ্রুপ। গোল্ডেন ইস্পাতের পর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছে এইচএম স্টিল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। পুরনো লোহার টুকরো থেকে প্রথমে বিলেট তৈরি করে তারপর ইস্পাত পণ্য উৎপাদন হচ্ছে এখানে।
এইচএম স্টিলের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকে আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রাখছি। ব্যাংক চেষ্টাও করছে। কিন্তু ডলারের সংকট থাকায় সময়মতো এলসি করতে পারছি না। কারখানায় কাঁচামালের সংকট আছে। উৎপাদনও কমেছে। সিমেন্টের সক্ষমতার ২০ শতাংশ চালু রেখেছি। আর ইস্পাত উৎপাদন চালু রেখেছি সক্ষমতার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত, দামের অস্থিরতা তো আছেই। আমদানিতে বেশির ভাগই ডেফার্ড এলসির ওপর নির্ভরশীল। ডেফার্ড এলসির ক্ষেত্রে আজ ডলার যদি ১১০ টাকায় করি তা ম্যাচিউর হবে ছয় মাস পর। এখন পণ্যের চালান এক মাসের মধ্যে চলে আসছে। ডলারের বিনিময় হার ১১০-১১২ টাকা হিসাব করে দাম ধরে আমরা ফিনিশড প্রডাক্ট বাজারে বিক্রিও করে দিলাম। কিন্তু পরে যখন পেমেন্ট দিতে যাই, তখন দেখছি ডলারের দর ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দিতে হচ্ছে। তাহলে উৎপাদনকারী হিসেবে তো আমি ঘাটতি বা লসে পড়ে গেলাম।’
আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের শীর্ষ রাজস্ব আহরণকারী সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রাজস্ব আহরণও এখন কমতির দিকে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ শতাংশ কম। বিশেষ করে গত দুই মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের তুলনায় ঘাটতি ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। আর গত অক্টোবরে রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে লক্ষ্যের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরীর বক্তব্য হলো ‘আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই আমদানি করে আনতে হয়। যদিও এখনকার বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় বিপদে আমদানিকারকরা। ডলারের অপ্রতুলতায় যোগাযোগ করলেও বেশির ভাগ ব্যাংকই এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। ডলারের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির কারণে টাকায় হিসাব করলে দেখা যায় আমরা আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম আমদানি করতে পারছি। আর এতে করেই বড় আমাদনিকারকরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা ভোগ্যপণ্য এনে বিক্রি করে ফেলি, কিন্তু ডলার সেটলমেন্টে যাই আরো অনেক পরে। খাদ্যপণ্য কেনার সময় ডলার যত টাকা দরে হিসাব করে এলসি খুলেছি, নিষ্পত্তির সময় তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে রীতিমতো মূলধন ঘাটতিতে পড়ে যেতে হচ্ছে।’
টাকার অবমূল্যায়নে রফতানিকারকদের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কথা থাকলেও পরিস্থিতি এখন তাদেরও প্রতিকূলে বলে জানালেন প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। দেশের শীর্ষ রফতানিকারক হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটির এ শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলারের বিনিময় হার ধরে রাখার মতো ভুল নীতির কারণে আমরা রফতানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছি। যদি বিনিময় হার সময়মতো বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া যেত, তাহলে টাকার অবমূল্যায়নে একটা ধাক্কা আসতো ঠিকই কিন্তু এতোদিনে পরিস্থিতি ঠিকই স্বাভাবিক হয়ে আসতো। আবার দাম বেঁধে রাখলেও আমদানিকারকদের ঠিকই অনানুষ্ঠানিকভাবে ডলার ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এলসি খুলতে দেশের বড় মাপের প্রতিষ্ঠিত শিল্পোদ্যোক্তারাও এখন বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে ধরনা দিচ্ছেন। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক কি সেটা এখনো অনুধাবন করতে পারেনি? উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে আরো যত বেশি দেরি হবে সংকটও ততটাই গভীর হবে।’
১৯৮৪ সালের নভেম্বর থেকে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক। দীর্ঘ ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারে এখনকার মতো পরিস্থিতি আর কখনই দেখেননি বলে জানালেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আগে ব্যাংক আমাদের কাছে এসে বসে থাকত। আমার জীবনে দুয়েকটি সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়া ব্যাংকে যাওয়ার কখনো প্রয়োজনই পড়েনি। এখন তো শুধু এলসি খোলার জন্য আমাদের ব্যাংকে গিয়ে বসে থাকতে হবে। আমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ পর্যায়ে এসেছি। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর থেকে ব্যবসা পরিচালনায় এমন পরিস্থিতি আর কখনো দেখিনি। ডলারের দর রাতে ঘুমানোর আগে দেখি এক রকম আর ঘুম থেকে উঠে শুনি আরেক রকম। রাতে ঘুমানোর সময় ডলার ১১১ টাকা আর উঠে দেখি ১২৫ টাকা। তাহলে ব্যবসায় এক রাতেই ১৫ শতাংশ নেই।’
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে আমদানি দায় পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন নেমে এসেছে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ডলারের তীব্র সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এখন এলসি খুলতে রাজি হলেও তা করছে শর্তসাপেক্ষে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাইরে থেকে ডলার সংগ্রহ করে দেয়ার শর্তও দেয়া হচ্ছে। চাহিদামতো এলসি খুলতে না পেরে এখন শিল্প কাঁচামাল, নিত্যপণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতির মতো অত্যাবশ্যকীয় আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ । এ চার মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে মোট ২ হাজার ১৮২ কোটি ডলারের। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় এলসি খোলা হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ৪৬৬ কোটি ডলারের। এ সময় ব্যাংকগুলোর এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে ২৪ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকগুলো এলসি নিষ্পত্তি করেছিল ২ হাজার ৮৯৪ কোটি ডলারের। সেখান থেকে কমে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তা নেমে এসেছে ২ হাজার ১৯৭ কোটি ডলারে।
বনিক বার্তা